লিয়াকত আলি শাহ সন্ত্রাসের পথ বর্জন করিয়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরিতে উদ্যোগী হইয়াছিলেন, না কি আত্মসমর্পণের অজুহাতে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর হইতে নেপালের পথে ভারতে প্রবেশ করিয়া ফিদাইন হামলার প্রস্তুতি লইতেছিলেন, এই সংক্রান্ত কাজিয়ায় দিল্লি পুলিশ ও জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ বিড়ম্বিত। আত্মসমর্পণকারী প্রাক্তন জঙ্গিদের পুনর্বাসনের জন্য জম্মু-কাশ্মীর সরকারের একটি ঘোষিত নীতি রহিয়াছে। তদনুযায়ী এই সরকার আত্মসংশোধনেচ্ছু সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসিত করিয়া আসিতেছে। লিয়াকত আলি শাহও নাকি তেমনই এক জন প্রাক্তন জঙ্গি, যিনি আত্মসমর্পণ করিতে আসিতেছিলেন। তিনি যে স্ত্রী-পরিবার লইয়া আসিতেছিলেন, তাহাতে এই অনুমান অস্বাভাবিক নয় যে, ফিদাইন হামলা তাঁহার অভিপ্রায় ছিল না। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়াইয়া বিশেষ জোরের সহিত এই যুক্তি দিয়াছেন। আপাত-বিশ্বাস্য যুক্তি সতত সত্য, এমন কথা নিশ্চয়ই বলা চলে না, সপরিবার ভারতে প্রবেশ একটি কৌশলও হইতে পারে। কিন্তু অন্য দিকে, ইহা যে সত্যই আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নয়, তাহার কৌশলমাত্র, সে কথাও আগে হইতে ধরিয়া লওয়া চলে না, তাহা হইলে আত্মসমর্পণের নীতিই বানচাল হইয়া যায়।
সমস্যাটি নিঃসন্দেহে জটিল। অতীতে দেখা গিয়াছে, একাধিক সন্ত্রাসবাদী হামলার সহিত আত্মসমর্পণকারী সন্ত্রাসীদের নাম জড়াইয়া গিয়াছে। সরকারি পুনর্বাসনের যাবতীয় সুযোগসুবিধা গ্রহণ করিয়া এবং সেই সুবাদে ‘সন্দেহভাজন তালিকা’ হইতে নিজের নাম কাটাইয়াও বহু প্রাক্তন জঙ্গি নূতন করিয়া সন্ত্রাস ও নাশকতার পথে ফিরিয়াছে। জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ইহা যেমন সত্য, অসমের আত্মসমর্পণকারী আল্ফা জঙ্গিদের (সাল্ফা বলিয়া যাহারা সমধিক পরিচিত) ক্ষেত্রেও তেমনই সত্য। আবার ইহাও বহুশ্রুত যে, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে জেহাদের প্রশিক্ষণ লইতে যাওয়া শত-শত কাশ্মীরি তরুণ হিজবুল কিংবা লস্কর নেতৃস্থানীয়দের আচরণে বীতশ্রদ্ধ হইয়া সন্ত্রাসের পথ পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত। রাজ্যের জঙ্গি-পুনর্বাসন নীতি ওই বিপথগামী তরুণদের মূল স্রোতে ফিরাইবার ভাবনা হইতেই গৃহীত। নীতিটির অপব্যবহারের আশঙ্কা নাই, এমন নয়। কিন্তু তাই বলিয়া কি নীতিটি প্রত্যাহার করিয়া লওয়া হইবে? আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের সহিত পুলিশ-প্রশাসন যদি সঠিক আচরণ না করে, যদি তাঁহাদের সর্বদা সন্দেহের চোখে দেখা হয়, কিংবা এখনও জঙ্গিপনায় লিপ্ত জেহাদিদের সম্পর্কে খবর সংগ্রহ বা তাহাদের গোপন ডেরার তথ্য সরবরাহের জন্যই তাঁহাদের ব্যবহার করা হয়, তবে সমাজও কিন্তু মূল স্রোতে তাঁহাদের গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিবে। পুলিশের বিশ্বাসভাজন হইতে গিয়া আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিরা যদি অবশিষ্ট সমাজের চক্ষে সন্দেহভাজন বা ‘বিশ্বাসঘাতক’ প্রতিভাত হন, তবে সেটাও তাঁহাদের সম্মানজনক পুনর্বাসন হইবে না।
সুতরাং অত্যন্ত সতর্কতা এবং বিচক্ষণতার সহিত এই বিষয়টির মোকাবিলা করা দরকার। আত্মসমর্পণের ছদ্মবেশে, হৃদয় পরিবর্তনের অনুশোচনা প্রদর্শন করিয়া অনুতাপহীন কট্টর জঙ্গিরা পরবর্তী হামলার প্রস্তুতি লইতেছে না, ইহা নিশ্চিত করা অবশ্যই দরকার। একই সঙ্গে, যিনি যথার্থই কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং আত্মশুদ্ধি করিয়া নূতন পথে চলিতে আন্তরিক, তিনি যাহাতে নিরুৎসাহ না হন, তাহাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এখানেই প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তথ্যানুসন্ধানের দক্ষতা ও তাগিদ জরুরি। তাহার পরিবর্তে সরকারেরই দুইটি সংস্থা (এ ক্ষেত্রে দিল্লি ও কাশ্মীরের পুলিশ) পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপে ব্যস্ত হইলে সমগ্র প্রক্রিয়াটিই ভণ্ডুল হইয়া যাইতে পারে। সামরিক বাহিনীকেও সরকারি নীতি প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করিতে দিলে চলিবে না। বাহিনী রাজনীতির সূক্ষ্ম মর্ম বোঝে না, লড়াই বোঝে। জঙ্গিদের সামরিক ভাবে পরাস্ত করাতেই তাহার আগ্রহ বেশি। কিন্তু নিজেরই দেশবাসীর একাংশের সহিত দখলদার বাহিনীর মতো আচরণও আদৌ গণতন্ত্রসম্মত নয়। তাই জঙ্গি দমনে কঠোরতার পাশাপাশি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার সহিত অনুতপ্ত জঙ্গিদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াও চালাইয়া যাওয়া দরকার। |