নিরিবিলি সোনালি সৈকত। বালুকাবেলায় আছড়ে পড়ছে সফেন নীল জলরাশি। শঙ্করপুরে মনোরম এই প্রাকৃতিক দৃশ্য কেবলই অতীত। ভেসে যাওয়া জিওটিউব বাঁধের সাক্ষী হিসাবে গোটা সৈকতে এখন জেগে শুধু কাঠের গুঁড়ির খাঁচা। যার জন্য সহজে সমুদ্রে নামতেও পারেন না পযর্টকরা। মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছায় দিঘাকে গোয়া বানাতে ব্যস্ত প্রশাসন। নিদেনপক্ষে কাঠের গুঁড়িগুলো তুলে ফেলতেও উদ্যোগী হয়নি কেউ। ‘দুয়োরানি’ শঙ্করপুর থেকে তাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে হতাশ বাঙালি।
মন্দারমণি, তাজপুর পরিচিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই দিঘার পাশের নিরিবিলি সৈকত শঙ্করপুরে ভিড় জমাতেন পর্যটকেরা। ক্রমশ তৈরি হয় একের পর এক বেসরকারি হোটেল-লজ। মৎস্য দফতরের উদ্যোগে গড়ে ওঠে রাজ্যের প্রথম মৎস্য বন্দর। এমনকী মৎস্য দফতরের ‘বেনফিশ’ ও ‘পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য উন্নয়ন নিগম’ সংস্থা দু’টিও নিজেদের অতিথিশালা খোলে। ১৯৯১ সালে শঙ্করপুরকে দিঘা উন্নয়ন পর্ষদের আওতায় আনা হয়।
তবে, পরিকাঠামোর উন্নয়নে কাজ বিশেষ হয়নি তারপরেও। উল্টে সমুদ্র ভাঙন ঠেকাতে পর্ষদ ২০০৯ সাল নাগাদ শঙ্করপুর উপকূলে ‘জিওটিউব’ বসানোর কাজ শেষ করার পরে যত সমস্যা শুরু হয়। দেড় কিলোমিটার সৈকতের প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে বড়বড় কাঠের গুঁড়ির খাঁচা তৈরি করে তাতে বোল্ডার, পাথর, বালি ঢুকিয়ে জিওটিউব পাতা হয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় সেই বাঁধ। পড়ে থাকা কাঠের গুঁড়ির খাঁচায় বন্দি এখন সৈকত। হারিয়েছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য। সমুদ্রে নামাটাও কঠিন। বিকল্প হিসাবে লোকজন তাই এখন চলে যায় মন্দারমণি, তাজপুরে। |
জিওটিউব বাঁধের সাক্ষী শুধু কাঠের গুঁড়ির খাঁচা।—নিজস্ব চিত্র। |
শঙ্করপুরে আগের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ পযর্টক কমে গিয়েছে জানিয়ে দিঘা-শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অনাদি দাস আক্ষেপ করেন, “তড়িঘড়ি জিওটিউব বসানোটাই কাল হল। বাঁধ তো রইল না। কাঠের গুঁড়িগুলো এত বিশ্রি ভাবে দাঁড়িয়ে, দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়।”
কাঠের গুঁড়িগুলো তোলা হচ্ছে না কেন?
কাঁথি সেচ দফতরের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার স্বপনকুমার পণ্ডিত বলেন, “দিঘা থেকে জলধা পর্যন্ত সমুদ্রবাঁধ তৈরি ও সৌন্দর্যায়নে প্রায় ৮৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বোল্ডার দিয়ে যখন পাড় বাঁধানো হবে, তখনই ওই খাঁচা তুলে ফেলা হবে।”
এতদিন এই কাজ হয়নি কেন?
জবাবে নিরুত্তরই থেকেছেন সেচ দফতর ও দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের কর্তারা।
স্থানীয় হোটেল মালিকদের অভিযোগ, পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে শঙ্করপুরের পরিকাঠামো উন্নয়নেও কিছু করেনি পর্ষদ। হাওড়া থেকে পর্যটকদের আসার জন্য নির্ধারিত বাস থাকলেও তা শঙ্করপুর পর্যন্ত আসে না। আসবে কী করে? বাসস্ট্যান্ড-ই তো নেই। দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের অফিসঘর ও পার্ক তৈরির জন্য দু’বছর আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে শিলান্যাস করা হলেও কোনওটাই তৈরি হয়নি। সমুদ্রের পাড়ে দু’দণ্ড বসার জন্য দু’একটা বেঞ্চ পাতারও ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। এই অবস্থায় ছুটি কাটাতে শঙ্করপুরে এসে এক দিনেই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বধর্মানের গৌতম রায়, বেলুড়ের হিমাংশু দাস, শিবানী দাসেরা। যাওয়ার আগে শিবানীদেবীর আক্ষেপ, ‘‘শঙ্করপুরে এসে এমন দৃশ্য দেখব ভাবিনি। যত না বিরক্ত হচ্ছি তার চেয়ে বেশি দুঃখ পাচ্ছি এই পরিণতি দেখে।’’
প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক স্বদেশ নায়কের অভিযোগ, “দিঘায় কোটি-কোটি টাকা খরচ করে সৈকত উৎসব হচ্ছে। যে পরিমাণ টাকা খরচ করা হয়েছে, তার সিকিভাগও শঙ্করপুরের জন্য বরাদ্দ করা হলে সৈকতের চেহারাটাই বদলে যেত। পর্ষদই দিঘাকে সুয়োরানি আর শঙ্করপুরকে দুয়োরানি বানিয়েছে।”
দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের নির্বাহী আধিকারিক সৌমেন পাল অবশ্য বৈষম্যের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘পর্ষদের পক্ষ থেকে শঙ্করপুর যাওয়ার রাস্তাঘাট তৈরি করা ছাড়াও পথবাতি বসানো হয়েছে। সম্প্রতি দেড় কোটি টাকা খরচ করে চৌদ্দমাইল থেকে শঙ্করপুর পর্যন্ত রাস্তাটির মেরামত ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটের পর শঙ্করপুরের বাসস্ট্যান্ড-সহ অন্য কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে নতুন পরিচালন সমিতি।” |