মাত্র উনিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছে গাইঘাটার মেয়ে শম্পা ঘোষ। শ্বশুরবাড়িতে তাঁর অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয়। তাঁর বাবা মণীন্দ্র ঘোষ থানায় অভিযোগে জানিয়েছিলেন, দেনা পাওনার কারণে শ্বশুরবাড়িতে তাঁর মেয়ের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হত। তার জেরেই এই ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু। গত বছরের গোড়ার দিকে একই কারণে ব্যারাকপুর টালিখোলা এলাকার পার্বতী মণ্ডলকে পুড়িয়ে মারে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোক জন।
সমীক্ষা বলছে, বছর বছর বাড়ছে এমনই বধূহত্যা বা নির্যাতনের ঘটনা। কলকাতা শহর লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পুলিশের হিসেবে, ২০১১ সালে যেখানে জেলায় নারী নির্যাতনের ১৫০০টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে, ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭০০টিতে। যার ৮০ শতাংশই পণের দাবিতে অত্যাচারের ঘটনা। ২০১১ সালে হাবরা থানা এলাকায় পণের জন্য ৮ জন মহিলার মৃত্যুর অভিযোগ হয়েছে। ২০১২ সালে একই কারণে ওই এলাকায় প্রতি মাসে গড়ে ১ জন করে মহিলার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে নারী নির্যাতন রুখতে প্রচার করেও কোনও লাভ হচ্ছে না। মেয়েদের বেশির ভাগের মতে, গলদ থাকছে গোড়াতেই। বেশির ভাগ সময়ে অভিযোগ নিতে চায় না স্থানীয় থানা।
বনগাঁ তালতলার বাসিন্দা এক মহিলা বলেন, “আমার স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করার পরেও কিন্তু পুলিশ গ্রেফতার করছিল না। পরে নেতাদের হস্তক্ষেপে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।” গাইঘাটার ডিঙামানিক এলাকার এক বধূর কথায়, “স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদ না করে অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে। বিয়ের দিনই আমি পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। পরে মানবাধিকার সংগঠনের কথায় পুলিশ অভিযোগ নেয়।”
একটি মানবাধিকার সংগঠনের গাইঘাটা শাখার সভাপতি নন্দদুলাল দাস বলেন, “আমরা দেখেছি, নির্যাতিতা মেয়েটির পরিবার থানায় অভিযোগ করতে গেলেই তাদেরকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়। অভিযোগ নিতে গড়িমসি করা হয়। অভিযুক্তেরা যদি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হন, তাহলে তো কথাই নেই। পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে না। দীর্ঘদিন ধরে টালবাহানা করে। পরে এমন ভাবে মামলা সাজায় যাতে অভিযুক্তেরা দ্রুত জামিন পেয়ে যায়।” তাঁর আরও দাবি, অনেক ক্ষেত্রে মেয়েটির বাপের বাড়ি থেকে খুনের অভিযোগ দায়ের হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কেবল একটি আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা রুজু করে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে জেলা পুলিশের কর্তারা এমন অভিযোগ স্বীকার করতে চাননি। এক আধিকারিকের কথায়, “তৎপরতার সঙ্গেই অভিযোগ নেওয়া হয়। এতগুলি অভিযোগের নথিভুক্তিই তার প্রমাণ।”
বনগাঁ মহকুমা আদালতের মুখ্য সরকারি আইনজীবী সমীর দাস জানান, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি দূরে হওয়ার ফলে মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত হলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একমাত্র সাক্ষী থাকেন শ্বশুরবাড়ির এলাকার লোকজন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁদের নানা ভাবে প্রভাবিত করেন এবং সাক্ষীরাও নিজেদের দিকটা ভেবে নিজেদের এলাকার লোকেরই পক্ষ নেন। উল্টো দিকে, মেয়েটির বাপের বাড়ির লোকজনের পক্ষে নিয়মিত ওই এলাকায় গিয়ে সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না। দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসেন না অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেন।” অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষী যদি বা জোগাড় করা যায়, তাদের দাবি মেটাতে অনেক সময়েই হিমশিম খেতে হয় মেয়েটির পরিবারের লোকজনকে। হাবরার মছলন্দপুরের এমনই এক নিহত গৃহবধূর বাবা বলেন, “সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে এলে তাদের যাতায়াত খরচ তো দিতেই হয়। আরও নানা ধরনের দাবি থাকে। সামান্য খেতমজুরের কাজ করি। আজকাল এই খরচ চালানো, দাবিদাওয়া মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়াচ্ছে। জানিনা, মেয়ের জন্য বিচার পাব কিনা।”
জেলা সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, নারী নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ নেওয়ার জন্য জেলায় দু’জন সুরক্ষা আধিকারিক রয়েছেন। তাঁরা কোনও অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেন। প্রতি থানাতেই নারী নির্যাতন সংক্রান্ত বিষয়গুলি দেখার জন্য এক জন করে আধিকারিক থাকেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পণপ্রথার বিরুদ্ধে কাজ করেন। রাজ্য মহিলা কমিশনই বিভিন্ন সময় আলোচনাসভা, সচেতনতা কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে। কমিশনের তরফে আইনি সহায়তাও দেওয়া হয়।
তবে জেলা পুলিশের একাংশের মত, এমন অপরাধের জন্য আর্থ সামাজিক অবস্থাই দায়ী। তাঁদের বক্তব্য, উত্তর ২৪ পরগনার গ্রামীণ এলাকা বা অন্যান্য দরিদ্র এলাকাগুলির অধিকাংশ মানুষই দিনমজুরি করে সংসার চালান। পণ নিয়ে ছেলের বিয়ে দিলে সহজেই বেশ কিছু কাঁচা টাকা হাতে আসে। তাই বিয়েতে ইচ্ছেমতো পণের দাবি করা হয়। অনেক সময়ে প্রথমে কম পণে বিয়ে মিটিয়ে নেওয়া হয়। পরে আরও টাকার দাবি করা হয়। না মিটলেই শুরু হয় অত্যাচার।
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “এক বার পণ দিলেই ছেলের বাড়ি প্রশ্রয় পেয়ে যায়। তাই গোড়াতেই সচেতন হওয়া দরকার। না হলে এমন গার্হ্যস্থ হিংসা চলতেই থাকবে।” পাশাপাশি তাঁর ব্যাখ্যা, মেয়েরা আগের তুলনায় সচেতন হয়েছে বলেই থানায় দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। মুখে বুজে মার না খেয়ে পুলিশের কাছে যাচ্ছে তারা। |