ক্যামেরা কাঁধে শনি-রবিবারে শহর ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়তেন দুই বন্ধু। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তাঁরা। কিন্তু দু’জনের শখ ছবি তোলা। সেই শখ মেটাতে গিয়েই শনিবার বাসন্তী হাইওয়ের ‘মৃত্যু-ফাঁদে’র কবলে পড়লেন তাঁরা। গাড়ির চালক-সহ এক বন্ধু দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। আর এক বন্ধু আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিত্সাধীন।
পুলিশ জানিয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী হাইওয়েতে একটি বাঁকের মুখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ দিন সকালে একটি গাড়ি রাস্তার ধারের খালে পড়ে যায়। বানতলামুখী ওই গাড়িতে চালক-সহ তিন জন ছিলেন। দুর্ঘটনায় চালক আশিসকুমার দত্ত (৩৫) এবং অচিন্ত্যকুমার ভড়ের (৩৯) মৃত্যু হয়। জখম হন সুদীপ্ত ঘোষ (৩৭)। সুদীপ্ত কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। অচিন্ত্য আর সুদীপ্ত
দুই বন্ধু। তাঁরা সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে একটি সফটওয়্যার সংস্থার কর্মী। দু’জনেরই বাড়ি বরাহনগরে। গাড়ির চালক আশিসের বাড়ি
হুগলির বৈদ্যবাটীতে।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, বরাহনগর থেকে সাদা রঙের টাটা ইন্ডিকা গাড়ি ভাড়া করে এ দিন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ অচিন্ত্য এবং সুদীপ্ত ক্যামেরা নিয়ে পাখির ছবি তুলতে বানতলার দিকে যাচ্ছিলেন। গাড়ি বেশ জোরেই ছুটছিল। সকাল আটটা নাগাদ বানতলার কিছুটা আগে কয়লা ডিপো এলাকায় বাঁকের মুখে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় গাড়ি খালের জলে পড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানান, সকালে কয়েক পশলা বৃষ্টিতে রাস্তা পিছল ছিল। সেই কারণে বাঁকের মুখে গাড়ির চাকা আচমকা হড়কে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। |
খালে পড়া গাড়ি থেকে যাত্রী ও চালককে উদ্ধার করতে ছুটে যান স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে চালক-সহ তিন জনকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেখানেই মারা যান অচিন্ত্য এবং গাড়ি চালক আশিস।
প্রাথমিক চিকিত্সার পরে সুদীপ্ত এ দিন বলেন, “সকাল সাতটা নাগাদ বরাহনগর থেকে বেরিয়েছিলাম। সামনে গাড়ির চালকের পাশে বসেছিল অচিন্ত্য। আমি পিছনের আসনে। আশিসই গাড়ির মালিক। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার হলে বরাবর আশিসই আমাদের নিয়ে যেতেন।”
অচিন্ত্যর বাড়ি বরাহনগরের শম্ভুনাথ দাস লেনে। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন। বাবা অহীন্দ্র ভড় এবং মা নীলিমাদেবীর একমাত্র সন্তান তিনি। এ দিন দুপুরে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মৃত্যুর খবর বৃদ্ধ বাবা-মাকে তখনও জানানো হয়নি। অচিন্ত্যর কাকিমা শিখাদেবী জানান, সুদীপ্তর বাড়ি থেকেই প্রথমে টেলিফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানানো হয়। প্রতি শনি, রবিবার গাড়ি নিয়ে ছেলের বাড়ির বাইরে যাওয়া খুব বেশি পছন্দ করতেন না অহীন্দ্রবাবু। শুক্রবার রাতেও ছেলেকে নিষেধ করেছিলেন এ দিন সকালে না বেরোতে। অচিন্ত্যর পাড়ার ছেলেরা জানালেন, ক্যামেরা আর কম্পিউটার ছাড়া অন্য কিছুতে মন ছিল না তাঁর। খুব মিশুকে ছিলেন। অচিন্ত্যর খবরে তাই গোটা পাড়া মুহ্যমান।
বরাহনগরেরই মণ্ডলপাড়া লেনে সুদীপ্তর বাড়ি। তাঁর মা রমাদেবী বলেন, “ছেলেবেলা থেকেই অচিন্ত্যর সঙ্গে সুদীপ্তর ঘনিষ্ঠতা। অচিন্ত্যই সকালে ফোন করে বলল, গাড়ি এসে গেছে, বেরিয়ে পড়। তখন কী আর জানতাম...।” গলা ধরে আসে রমাদেবীর। সুদীপ্তর পাড়ার বাসিন্দারা জানান, দুর্ঘটনার খবর প্রথমে জানতে পারেন বরাহনগর পুরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর (সুদীপ্তর বাড়ি ওই ওয়ার্ডেই) ব্রজেন মণ্ডল। তিনিই সুদীপ্তর বাড়ি গিয়ে তাঁর মাকে
খবর দেন। সেখান থেকে খবর যায় অচিন্ত্যর বাড়িতে।
পুলিশ জানায়, গত কয়েক মাসে বাসন্তী হাইওয়েতে চারটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। দু’টি ক্ষেত্রে যাত্রিবাহী বাস উল্টে যায়। তবে তাতে কেউ হতাহত হননি। বুধবার বাসন্তী হাইওয়ের কাঁটাতলায় ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু হয় কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলমের স্বামী আবদুল মোমিনের। কী কারণে বারবার বাসন্তী হাইওয়েতে দুর্ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে শুক্রবার এলাকা পরিদর্শনে যান রাজ্য পুলিশের আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) মিহির ভট্টাচার্য। ওই এলাকায় দুর্ঘটনা রোধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে তিনি জেলার পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশ সূত্রের খবর, ডিএসপি পদমর্যাদার এক অফিসারকে দুর্ঘটনার কারণগুলি তদন্ত করে দেখতে বলেছেন মিহিরবাবু। এর পাশাপাশি, বাসন্তী হাইওয়েতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া-সহ ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। |