এত বড় পরীক্ষা আগে কোনও দিন দেখেনি বাংলা। পরিবর্তনের জমানায় ভাবী প্রজন্ম গড়ার কারিগর নেবে শিক্ষা দফতর। নেওয়া হবে ৩৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক। তার জন্য আজ, রবিবার পরীক্ষায় বসবেন ৪৫ লক্ষ প্রার্থী। পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছ’হাজার। স্কুলবাড়িতে কুলোচ্ছে না। অনেক জায়গায় বাঁধতে হয়েছে ম্যারাপও। ভাড়া করতে হয়েছে চেয়ার টেবিল। এক ঘণ্টার পরীক্ষা, যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয় তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। থাকছে ঢালাও পুলিশি ব্যবস্থাও। তবু প্রশ্ন উঠছে, শেষ পর্যন্ত ভালয় ভালয় মিটবে তো এই এত বড় রাজসূয় যজ্ঞ?
প্রশ্ন উঠছে কারণ, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদগুলিকে বাদ দিয়ে একক ভাবে পরীক্ষা পরিচালনা করছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। এক দিনে এত বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর পরীক্ষা নেওয়ার কোনও অভিজ্ঞতা তাদের নেই। এত দিনের রেকর্ড ছিল ২০১৩-র মাধ্যমিক। পরীক্ষার্থী ছিল সাড়ে ১০ লক্ষ। রবিবার পরীক্ষা দেবেন তার চেয়েও ৩৫ লক্ষ বেশি প্রার্থী। পর্যদ তা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভাবে সারতে পারবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে শিক্ষকমহলে। কারণ ইতিমধ্যেই বেশ কিছু অব্যবস্থার অভিযোগ তুলেছেন পরীক্ষার্থীরা।
পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য অবশ্য শনিবার দাবি করেছেন, সুষ্ঠু ভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য যাবতীয় বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যদিও এত বড় পরীক্ষার জন্য কেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ বা নিয়োগের পরীক্ষাগ্রহণে অভিজ্ঞ কোনও সরকারি সংস্থার সাহায্য নেওয়া হল না, উঠছে সে প্রশ্নও। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, বাম আমলে সংসদগুলিকে দিয়ে পরীক্ষার বন্দোবস্ত করায় নানা রকম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সে কারণেই কেন্দ্রীয় ভাবে পরীক্ষা নেওয়া প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে স্কুলশিক্ষা দফতর। এবং সেই অনুযায়ী নির্দেশিকা জারি করা হয় প্রায় এক বছর আগে।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য, “পর্ষদ সভাপতির সঙ্গে আমার নিয়ত যোগাযোগ আছে। উনি আমাকে জানিয়েছেন, পরীক্ষার সব রকম ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই সারা হয়ে গিয়েছে। আশা করি, পরীক্ষা নির্বিঘ্নে হবে।” পর্ষদ সূত্রে জানানো হয়েছে, প্রত্যেক জেলায় একটি করে অতিরিক্ত পরীক্ষাকেন্দ্রের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যে পরীক্ষার্থীরা নিজেদের কেন্দ্র জানতে পারবেন না, তাঁরা ওই কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে যাবেন। যদিও অতিরিক্ত কেন্দ্রগুলি কোথায়, তা জানেন না পরীক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ। পরীক্ষার আগের রাতেও সংবাদমাধ্যমকে এই কেন্দ্রগুলির ঠিকানা জানায়নি পর্ষদ। |
এই পরিস্থিতিতে আজ রবিবার হাঙ্গামার আশঙ্কাও করছেন অনেক পরীক্ষার্থী। আইজি (আইনশৃঙ্খলা) বাণীব্রত বসু এ প্রসঙ্গে বলেন, “প্রত্যেক পরীক্ষাকেন্দ্রে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হবে। এ ছাড়াও টহলদারি ভ্যানের মাধ্যমে পরীক্ষাকেন্দ্রের আশপাশে নজরদারি চালানো হবে। প্রত্যেক কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসকর্ট ভ্যানের ব্যবস্থা থাকছে। পরীক্ষার্থীদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয় এবং নির্বিঘ্নে পরীক্ষা শেষ করার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
তৃণমূল শিক্ষাসেলের চেয়ারম্যান হিসেবে ব্রাত্যবাবু জানান, পরীক্ষার্থীদের সাহায্যের জন্য প্রত্যেক পরীক্ষাকেন্দ্রের কাছে দলের তরফে একটি তথ্য সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। মন্ত্রী এমনটা দাবি করলেও পরীক্ষার ২৪ ঘণ্টা আগে উঠে এসেছে বেশ কিছু অভিযোগ। কী রকম?
অভিযোগ ১: বাড়ি থেকে ৯০-১০০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি দূরে পরীক্ষাকেন্দ্র হওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন অনেকে। যেমন, বর্ধমানের কালনা শহরের অনেক পরীক্ষার্থীর আসন পড়েছে ১৫০ কিলোমিটার দূরে আসানসোলের বরাকরে। ব্যারাকপুরের অনেক পরীক্ষার্থীর আসন পড়েছে ৯০ কিলোমিটার দূরে সন্দেশখালিতে। এর উপরে গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো চেপে বসেছে ওয়েবসাইটের তথ্য বিভ্রান্তি। যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশনকে গাইঘাটা থানা এলাকায় বলা হলেও স্কুলটি গোপালনগর থানা এলাকায়। তেমনই পূর্ব চিল্কা লালচাঁদ হাইস্কুলের ঠিকানা পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে বলা হলেও সেটি আসলে ১০০ কিলোমিটার দূরে ওই জেলারই পাঁশকুড়ার এক প্রত্যন্ত এলাকায়। পুরুলিয়ার এক পরীক্ষার্থী জানান, মোবাইলে মেসেজ করে তিনি জেনেছিলেন, তাঁর পরীক্ষাকেন্দ্র সাঁওতালডিহি থানা এলাকার গগড়া হাইস্কুলে। স্কুলটি আসলে সেখান থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রঘুনাথপুর থানা এলাকায়।
অভিযোগের জবাবে কী বলছে পর্ষদ? পর্ষদ সূত্রে বলা হয়েছে, জেলার সব স্কুল ও সেখানকার পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বর দিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে পরীক্ষাকেন্দ্র নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং তার জেরেই এই সমস্যা বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ প্রশাসকেরা। এ ক্ষেত্রে মানিকবাবুর বক্তব্য, “প্রার্থীরা আবেদনপত্রে বলেছেন, জেলার যে কোনও স্কুলে পড়াতে তাঁদের কোনও সমস্যা নেই। তা হলে এখন পরীক্ষাকেন্দ্র কাছে-দূরে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন?”
অভিযোগ ২: পর্ষদের নিয়ম, পরীক্ষাকেন্দ্রে একটি বেঞ্চে দু’জনের বেশি পরীক্ষার্থী বসতে পারবেন না। কিন্তু অনেক স্কুলেই পরিকাঠামোর তুলনায় বেশি প্রার্থীর আসন ফেলা হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে ত্রিপল টাঙিয়ে ও চেয়ার-টেবিল ভাড়া করে অস্থায়ী ভাবে পরীক্ষার হল তৈরি করতে হয়েছে। আর এতেই বিপত্তির আশঙ্কা করছেন পরীক্ষার্থীর অভিভাবকেরা। তাঁদেরই এক জন বলেন, পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী পশ্চিম মেদিনীপুরের মৌপাল হাইস্কুলে বেঞ্চে দু’জন করে বসলে যেখানে ৫০০ জন পরীক্ষা দিতে পারবেন সেখানে আসন পড়েছে ৭০০ জনের। পাঁশকুড়ার একটি স্কুলে ৯০০ জনের সিটে ১৪৪০ জনের আসন পড়েছে। সেখানকার প্রধান শিক্ষক বলেন, “পরীক্ষার্থীদের বসার জন্য বেঞ্চ, পরীক্ষকদের জন্য চেয়ার-টেবিল আনা হলেও নজরদারির জন্য বাড়তি শিক্ষক কোথা থেকে মিলবে বুঝতে পারছি না।” কলকাতাতেও অনেক স্কুলে ডেকরেটরদের কাছ থেকে বেঞ্চ-চেয়ার-টেবিল ভাড়া করতে হয়েছে। কেন এই হাল? পর্ষদের কাছে এর সদুত্তর নেই। তবে বিকাশ ভবন সূত্রের খবর, অন্যান্য বারের মতো স্কুলশিক্ষা দফতর বা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদগুলিকে যুক্ত না করে গোটা পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা পর্ষদ একা করার ফলেই বিভ্রান্তি বেড়েছে।
অভিযোগ ৩: পরীক্ষার্থীদের জন্য কতগুলি হেল্পলাইন চালু করেছিল পর্ষদ। বৃহস্পতিবার থেকেই সেগুলি কার্যকর বলে দাবি পর্ষদ সভাপতির। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত ওই সব নম্বরে ফোন করে বহু ক্ষেত্রেই কোনও সুরাহা মেলেনি বলে একাধিক পরীক্ষার্থী জানিয়েছেন। পরীক্ষার আসন কোথায় পড়েছে, কত ক্ষণ আগে হলে পৌঁছতে হবে, অ্যাডমিট কার্ডের দু’টি অংশই নিয়ে যেতে হবে কি না, সে সব জানতেই ওই হেল্পলাইন খোলা হয়েছিল। মানিকবাবুর অবশ্য দাবি, কাজ করছে সব ক’টি নম্বরই। কিন্তু একসঙ্গে অনেক ফোন আসায় লাইন সংযোগে সমস্যা হচ্ছে।
অভিযোগ ৪: যাঁরা আবেদনপত্র কিনেও জমা দেননি, তাঁদের পরীক্ষাকেন্দ্রের নাম-ঠিকানা জানানো হয়েছে। ওই সব প্রার্থীদের পরীক্ষায় বসার কথাই নয়। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একাংশ মনে করছেন, শেষবেলায় মত পাল্টে যদি তাঁরা পরীক্ষাকেন্দ্রে হাজির হন সে ক্ষেত্রে গোলমালের আশঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। কারণ, আবেদনপত্রেরই একটি অংশ অ্যাডমিট কার্ড। তাই যাঁরা আভেদনপত্র কিনেছেন, অ্যাডমিট কার্ডের ওই অংশটিও তাঁদের কাছে রয়েছে। যদিও পর্ষদ নির্দেশে বলেছে, অ্যাডমিট কার্ডে পরীক্ষার্থীর ছবি ও ব্যাঙ্কের স্ট্যাম্প থাকলেই পরীক্ষায় বসা যাবে। একাধিক জেলা সূত্রের খবর, এত বেশি প্রার্থী এই পরীক্ষার জন্য আবেদন জানিয়েছেন যে অনেকেরই অ্যাডমিট কার্ডে ব্যাঙ্কের স্ট্যাম্প নেই। তাই কে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন, আর কে দেননি, তা বোঝা কঠিন। মানিকবাবু অবশ্য বলছেন, “আবেদনপত্র যাঁরা জমা দেননি পরীক্ষার্থীর চূড়ান্ত তালিকায় তাঁদের নাম নেই। তাঁর পরীক্ষাকেন্দ্রে গেলেও পরীক্ষায় বসতে পারবেন না।
|
পরীক্ষায় |
করতে হবে |
করা যাবে না |
পরীক্ষা ১টায়। তার আধ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে ঢোকা।
অন্তত ১৫ মিনিট আগে নির্দিষ্ট আসনে বসা।
আসল অ্যাডমিট কার্ডের দু’টি অংশই নিয়ে যেতে হবে।
সেখানে প্রার্থীর ছবি ও ব্যাঙ্কের স্ট্যাম্প থাকা আবশ্যক।
কালো বলপয়েন্ট পেন ব্যবহার।
প্রতিবন্ধীদের জন্য অতিরিক্ত ২০ মিনিট সময়। |
অ্যাডমিট কার্ডের ফটোকপি নিয়ে পরীক্ষায় বসা।
খোয়া যাওয়া অ্যাডমিট কার্ডের এফআইআরের কপি নিয়ে বসা।
ক্যালকুলেটর, মোবাইল ইত্যাদি ইলেকট্রনিক দ্রব্য নিয়ে হলে ঢোকা।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে হল ছেড়ে বেরোনো। |
|
আয়োজনের ইতিবৃত্ত |
• জেলায় জেলায় কমিটি, মাথায় জেলাশাসক।
• পরীক্ষাকেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে বহিরাগত নয়।
• কেন্দ্রপিছু একজন সরকারি অফিসারকে পরিদর্শনের ভার।
• কেন্দ্রপিছু সশস্ত্র পুলিশ।
• পরিবহণ ব্যবস্থা সচল রাখতে দফতরের কাছে আবেদন। |
|
|