রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট ঠিক কবে হবে, তা নিয়ে সংশয় যত বাড়ছে, ততই দ্বন্দ্ব বাড়ছে শাসক দলের অন্দরেও। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোট করা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তীব্র সংঘাতে আখেরে দল এবং দলনেত্রী সম্পর্কেই ভুল বার্তা যাচ্ছে বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ।
তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংঘাত বাড়িয়ে চলেছেন দলের সর্বভারতীয়
সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। কমিশনের ‘উদ্দেশ্য’ নিয়েই তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলছেন! শনিবারও যার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘটনার জল যে দিকে গড়াচ্ছে, সে দিকে নজর রেখে শাসক দলের অন্দরে কটাক্ষ শুরু
হয়েছে “তৃণমূলে এখন কার্যত মুকুলায়ন চলছে!”
তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, শুক্রবার রাজভবনে পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের বৈঠকেই জট কেটে সমাধানের রাস্তা অনেকটা খুলে গিয়েছিল। কমিশন-রাজ্য সংঘাতের বিষয় ছিল তিনটে ক’দফায় ভোট, কোন দফায় কী জেলা বিন্যাস এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী। তিনটে বিষয়েই রাজ্যপাল কমিশনের সঙ্গে কথা বলে সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান বার করার আশ্বাস পঞ্চায়েত মন্ত্রীকে দিয়েছিলেন বলে তৃণমূলের ওই সূত্রের বক্তব্য। দলের ওই অংশেরই মতে, সরকার ও কমিশনের মধ্যে রাজ্যপাল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছেন। এই অবস্থায় রাজ্যপালের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুকুলবাবু বিষয়টি ফের জটিল করে দিয়েছেন।
সুব্রত-ঘনিষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, “রাজ্যপালকে কটাক্ষ করায় সরকারি মুখপাত্রের পদ থেকে পঞ্চায়েত মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছিল। সাংসদ মুকুলবাবু এখন রাজ্যপালের এক্তিয়ার নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
অথচ তা নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কোনও হেলদোল নেই! বরং প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে!”
শাসক দলেরই এক প্রথম সারির বর্ষীয়ান নেতা অবশ্য বলছেন, রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিষয়ে কমিশনকে নমনীয় করে তোলার ব্যাপারে কোনও আশ্বাস দেননি। মুখ্যমন্ত্রীও কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি মেনে নিতে কখনওই রাজি ছিলেন না। তাই রাজ্যপালের মধ্যস্থতাতেও জট পুরোপুরি কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল না। এবং সেই জটই এখনও বহাল।
বস্তুত, দলের অন্দরে মুকুলবাবুর ভূমিকা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগে যথেষ্টই জটিলতা দেখা দিয়েছে। মুকুল-বিরোধীদের মতে, ১৭টির মধ্যে অন্তত ১৬টি জেলা পরিষদ দখল করতে পারবেন বলে মুকুলবাবু দাবি করেছেন। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি যেখানে গিয়েছে, যত দিন যাবে ওই লক্ষ্যপূরণ ততই কঠিন হয়ে উঠছে! দলীয় সূত্রের খবর, ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা পরিষদ জিতে রাজ্যে পরিবর্তনের ভিত রচনা হয়েছিল, সেই দুই জেলাতেই কোন্দল চরমে। দলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, “ওখানে পেশিবল না-খাটিয়ে জেলা পরিষদ ধরে রাখা কঠিন!”
পূর্ব মেদিনীপুরের কোন্দলের হাওয়া লেগেছে পশ্চিম মেদিনীপুরেও। পরিস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন এক তরুণ তৃণমূল নেতার বক্তব্য, “পশ্চিম মেদিনীপুরও দখল নিতে পারব কি না, সন্দেহ!” তার উপরে নলহাটির বিধানসভা উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় এবং ভোটের হার দেখে তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকেরই সন্দেহ, বীরভূমে অন্তর্দ্বন্দ্বে সংগঠন দুর্বল হয়েছে। রাতারাতি এই দুর্বলতা কাটানো যাবে না। একই হাল উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, পুরুলিয়া-সহ আরও বেশ কিছু জেলার। এমনকী, উত্তরবঙ্গের চিত্রও দলীয় নেতৃত্বের কাছে খুব স্পষ্ট নয়।
জেলায় জেলায় এমন ছবি দেখেই মুকুলবাবুরা পঞ্চায়েত ভোট পিছোতে উঠে-পড়ে লেগেছেন বলে তৃণমূলেরই অন্দরে চর্চা শুরু হয়েছে। তবে মুকুল-ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলছেন, “দলীয় নেতৃত্ব সব জায়গায় নিজেদের অবস্থা যাচাই করে তবেই নির্বাচনে যাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক!” উল্টো দিকে, দলের এক সাংসদের কথায়, “গত পঞ্চায়েতে দু’টি জেলা পরিষদ পেয়েছিলাম। এ বারে খুব রক্ষণশীল হিসেব করলেও তা অন্তত দশ হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে আরও অন্তত ৩টি জেলা পরিষদ গড়তে আমাদের বড় ভূমিকা থাকবে। কিন্তু যে ভাবে ভোট নিয়ে কমিশনের সঙ্গে সংঘাত বাড়ছে, তাতে অনেকেরই মনে হতে পারে যে, তৃণমূল আসলে ভোটই চাইছে না! এটা তো দলের পক্ষে খুবই খারাপ।”
গোটা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে দলের বর্ষীয়ান নেতাদের অনেকেরই মনে হচ্ছে, বিষয়টি আদালত অবধি নিয়ে যাওয়া হবে। যার প্রেক্ষিতে দলের ছাত্র-যুবদের একাংশের বক্তব্য, এ সবের জেরে দল তো বটেই, আদতে দলনেত্রীর স্বচ্ছ ভাবমূর্তিও মলিন করা হচ্ছে। যদিও আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিশেষত গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের পরে কলেজে ভোট বন্ধ না-করে সরকারের উপায় ছিল না বলে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন।
সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পাশে দাঁড়িয়ে দলের এক সাংসদ বলছেন, “মুকুল যা বলছেন বা যে ভাবে পদক্ষেপ করছেন, ঠিকই করছেন। মীরা পাণ্ডে কি নিজেকে টি এন শেষন মনে করছেন?” ওই সাংসদের মতে, কমিশনের একগুঁয়ে মনোভাবই পরিস্থিতি জটিল করছে। এখন তারা বিষয়টিকে আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চাইলে যাবে!
আর ভোট পিছোতে চাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উড়িয়ে মুকুলবাবুর স্পষ্ট কথা, “আমরা ফেব্রুয়ারিতেই ভোট করতে বলেছিলাম। তৃণমূল তো পুরো প্রস্তুত। কারণ, বাংলার যে মানুষ ২০১১-য় রাজ্যে পরিবর্তনের রায় দিয়েছিলেন, তাঁরা ১৩টি জেলা বামেদের হাতে আছে বলে সেখানেও পরিবর্তন চাইছেন। তাই আমরা সময়েই ভোট চাই। ভোট পিছোনোর প্রশ্নই নেই!”
মুকুলবাবু এমন কথা বললেও দলেরই কিছু নেতার আশঙ্কা, পঞ্চায়েত নিয়ে এই ডামাডোলে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটবে। এক বর্ষীয়ান সাংসদের মন্তব্য, “নিজের ঝোলে কেউ সেদ্ধ হতে চাইলে কী করা যাবে?” |