ভোটে লড়ে রাজনৈতিক দল। মাঝে রেফারির ভূমিকায় নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে সরকার আসবে কেন?
পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এ রাজ্যের সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে যে নজিরবিহীন সংঘাত তৈরি হয়েছে, তার আড়ালে থেকে যাচ্ছে এই গোড়ার প্রশ্নই। লোকসভা বা বিধানসভার ভোট কবে কী ভাবে হবে, তা ঠিক করার এক্তিয়ার পুরোপুরি জাতীয় নির্বাচন কমিশনের। তা হলে পঞ্চায়েত বা পুরসভার ভোটের ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে না কেন? এই প্রশ্নের সূত্র ধরে প্রশাসনিক মহলের একাংশ বলছে, বাম আমলের আইনের ফাঁক হাতে নিয়েই কমিশনের বিরুদ্ধে লড়ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের পরে দেশের বেশির ভাগ রাজ্যেই এখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে পঞ্চায়েত বা পুর-নির্বাচনের ব্যাপারে যাবতীয় ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। সরকার সেখানে মাথা গলায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, কেরল (যে দুই রাজ্যে
বহু বছর বাম শাসন ছিল) এবং উত্তর-পূর্বের একাধিক রাজ্য এখনও ব্যতিক্রম! সেখানে পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সহমত হতে হয় কমিশনকে। যা আসলে সরকারের হাতে ক্ষমতা রেখে দেওয়ারই নামান্তর। বর্তমান রাজ্য সরকারের সঙ্গে চলতি সংঘাতের প্রেক্ষিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনও খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে, অন্যান্য রাজ্যে কমিশনের স্বাধীনতা আরও বেশি।
অনেকের মতে, এ রাজ্যে বাম জমানায় শিক্ষা-সহ নানা ক্ষেত্রে যে ভাবে ‘অনিলায়নে’র ভূত চেপেছিল, পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনের বেলাতেও তা-ই হয়েছে! সিপিএমের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের তত্ত্ব মেনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সুতো বেঁধে রাখা হয়েছিল রাজ্য সরকারের হাতে! কেন্দ্রীয় সরকারের পঞ্চায়েতি রাজ দফতরের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে রাজ্য নির্বাচন কমিশনগুলির ক্ষমতায়নের জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছিল। তাদের সুপারিশ ছিল কমিশনকে পঞ্চায়েত ভোটের তারিখ ঘোষণা, নির্বাচন পরিচালনার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়ে আইন তৈরি করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করতে হবে রাজ্য সরকারগুলিকে। কারণ, রাজ্য নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংস্থা হলেও পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত আইন করে রাজ্য সরকারই। কিন্তু এই সুপারিশ সত্ত্বেও সিপিএম রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে ভোটের যাবতীয় এক্তিয়ার ছেড়ে দেয়নি। ক্ষমতায় এসে মমতাও এখন সেই আইনেরই ফায়দা তুলছেন।
বামেরা অবশ্য এমন ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। টাস্ক ফোর্সের সুপারিশের ভিত্তিতে বিহার-সহ অধিকাংশ রাজ্য যখন নিজ নিজ পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনেছিল, তখন এ রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী ছিলেন আনিসুর রহমান। তাঁর মতে, “শুধু পঞ্চায়েত এবং পুরভোটের দিন ঠিক করার ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা আমাদের আইনে আছে।
যাতে রাজ্যের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বা বড় কোনও কর্মসূচির সঙ্গে ভোটের নির্ঘণ্টের সংঘাত না বাধে। বাকি সব ক্ষমতা স্পষ্ট করেই কমিশনকে দেওয়া আছে।”
বাম সূত্রের ব্যাখ্যা, লোকসভা ভোট করার আগেও দেশের বড় বড় পরীক্ষাসূচির ব্যাপারে খোঁজ নিতে হয় জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে। প্রধানমন্ত্রী লোকসভা বা কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা করে ভোট চাইলেও কমিশন সেই মতো সূচি ঠিক করে। পঞ্চায়েত বা পুরসভা সরকার ভাঙা-গড়ার ভোট নয়। সেখানে পরীক্ষা বা অন্য কোনও কর্মসূচির সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর বিষয়টি মাথায় রেখেই এ রাজ্যের আইনে প্রয়োজনীয় আলোচনার সংস্থান রেখে দেওয়া হয়েছে। প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রীর দাবি, “কমিশনের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন থাকলে তো পদে পদে সংঘাত বাধত! বাম জমানায় রাজ্যে সাতটি পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে। কই সংঘাত তো বাধেনি!”
সিপিএমের তরফে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব আরও স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন, বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচন কমিশনগুলির আলোচনার ভিত্তিতে কিছু পর্যবেক্ষণ রাজ্যগুলির হাতে এসেছিল। তার ভিত্তিতেই এ রাজ্যে ২০১০ সালে তৎকালীন বাম সরকার আইন সংশোধন করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের মর্যাদা, নিয়োগ ও অপসারণের প্রক্রিয়া হাইকোর্টের বিচারপতির সমতুল করে দেয়। আগে যে পদের মেয়াদ তিন বছর ছিল, কেন্দ্রীয় সুপারিশের সূত্র ধরেই তা ৬ বছর বা ৬৫ বছর বয়স (যেটা আগে হবে) পর্যন্ত করে দেওয়া হয়। রবীনবাবুর কথায়, “বাম আমলের আইনের কথা তুলে যা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। এখনকার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার যে ৪৩(২) ধারা প্রয়োগ করে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছেন, সেই ধারা ২০১০ সালের সংশোধনের ফসল! দেশের সব রাজ্য নির্বাচন কমিশন মিলে তাদের অধিকার নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছিল, তার প্রেক্ষিতেই ২০১০-এ আইন সংশোধিত হয়েছিল।”
বাম জমানার আইনে যে ত্রুটি রয়ে গিয়েছে, তা সংশোধনে বর্তমান শাসকের কী ভাবনা? পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এতে বাম-ডানের কী আছে! একটা আইন তৈরি হয়ে আছে। আমিই (সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে) ১৯৭৩ সালে করেছিলাম। ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা ছিল না বলেই পরিবর্তনের প্রশ্ন ওঠেনি। এখন যা পরিস্থিতি হয়েছে, তাতে আমাদের ভাবতে হবে কী করা যায়।” শাসক শিবিরের একাংশের মতে, ভবিষ্যতে ওই আইন সংশোধনের ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে পঞ্চায়েতমন্ত্রীর কথায়। |