ল্যাজে পা
ক পাল বাচ্চার মাঝে ছড়িয়ে বসে আছি। স্কুলের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামের মহড়া। চ্যাঁ -ভ্যাঁ - মধ্যে কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। দশটা করে লাদেন মরলে রকম এক -একটা যন্তর হয়। এদের যাঁরা চেনেন না বা বাচ্চা বলে রেয়াত করেন, তাঁরা নিতান্ত নাদান। সন্ত্রাসবাদের মিনিয়েচার, উগ্রপন্থার পকেট সংস্করণ এই কপিকুলের হাতে আমি অসহায়।
এটা আসলে নাটক -ক্লাসে গণতন্ত্র -চর্চার ফল। ওদের বাড়িতে যেটার সম্যক অভাব। নাটক -ক্লাসে ওরা উন্মুক্ত হয়। নিজেদের ইচ্ছেমত প্রকাশ করে। মাত্রা ছাড়ায়। এটা বাড়িতে সম্ভব না। ওদের বাবা -মায়েরা ধরেই রেখেছেন যে ওরা ডাক্তার -ইঞ্জিনিয়ার বা নিদেন পক্ষে আইটি -কেরানি হবে। সে ক্ষেত্রে ওদের প্রকাশ, বিকাশ নিয়ে মাথা ঘামায় কোন ছাগল? কে না জানে, ভাল কেরিয়ার মানেই মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, বড়লোক মানেই বড় মানুষ? তাই তো ছোট থেকেই একটা ছাঁচ ঠিক করে দেওয়া। গুড মর্নিং, ব্রেকফাস্ট, স্কুল, জাঙ্ক ফুড, ইউনিট টেস্ট, হোমটাস্ক, টিউশন, কার্টুন, গুড নাইট। আর খেলা? আরে হতভাগা, মাঠে গিয়ে তো আর সচিন হতে পারবি না ! তার চেয়ে, কম্পিউটারে কার্গিল ব্যাট্ল লোড করে দিয়েছি, দুশমনদের গুলি করে করে মার। আমায় আর বিকাশ শেখাসনি রে মুখপোড়া !
১৮ বছরের বেশ কিছুটা আগে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ পড়েছিলাম বলে আমার এক স্বঘোষিত অভিভাবক আমাকে মা’র হাতে মার খাইয়েছিলেন। আসলে, ছোটদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা আমরা ভাবতেই পারি না, তাতে আমাদের শাসনের ধার কমে যায়। ওরা বড় হয়ে গেলে আমাদের অসুবিধে। বাচ্চারা দমিত হতে আসে, দমিত হতে হতে দমনের ভাষা শেখে, তার পর নিজেরাই দমনের মেশিনারি হিসেবে কাজ করে। আর এই ভাবে ব্যাটন -টা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে চালান হয়ে যায়। ভাবেই প্রচ্ছন্ন এক সামাজিক র‌্যাগিং আমাদের জন্মগত অধিকার। তাই আমাদের সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক স্থিতাবস্থাতেও ছোটদের প্রতি কানমলা, চিমটি, আঁচড় অপমান অতিশয় জায়েজ।
ছোট থেকেই আমাদের শেখানো হয় ঠাকুর, নমো করো। অর্থাৎ, মাথাটা ছোট থেকেই নিচু করে চলো, শিরদাঁড়াটা যেন বেঁকে থাকে। বামুন হলে পৈতে, মোছলমান হলে ছুন্নত, খেরেস্টান হলে ব্যাপটিজ্মের মূলে যে শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধন, তার পিছনেও আছে ধর্মের পায়ের তলায় আত্মবিশ্বাস বিসর্জন দেওয়ানোর সংগঠিত কৌশল। ধর্মের প্রলেপটা থাকলে আসলে আমাদের সুবিধে অনুশাসনের নামে ছোটবেলা থেকেই বেশ খাপে খাপে টাইট করে রাখা গেল। ধর্মের কারবারিদের মতো এত অর্গানাইজ্ড অসভ্যতা আর কারাই বা করতে পারে ! ধর্মগুরুর অভিষেক বা জন্মদিন বা সোনার খড়ম পুজোর পুণ্যদিবসে যে টাকাটা ঢালা হয়, তা দিয়ে বেশ কয়েকটা চেচনিয়া বা সোমালিয়ার শিশুর পুনর্বাসন সম্ভব।
বাচ্চারা সব বালির বস্তা। পেটাও, কাটো, মারো, ছুরি ঢোকাও, রেপ করো, ব্যবহার করো, তার পর ছুড়ে ফেলে দাও। সারা দুনিয়া জুড়েই এটা চলেছে। ২০০১ সালের সেন্সাস অনুযায়ী ভারতবর্ষে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১২ . মিলিয়ন, যার মধ্যে লক্ষ শুধু মাত্র অন্ধ্র প্রদেশে। সাইবার সিটির নীচে খাইবার অন্ধকার। এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যায় ভারতবর্ষ প্রথম : সরকারি হিসেবে ২০ মিলিয়ন। যদিও বেসরকারি হিসেব বলছে প্রায় ৫০ মিলিয়ন। এরা ৪০ ডিগ্রি গরমে বসে পাথর ভাঙে; দিনে ১৬ -১৭ ঘণ্টা কাজ করে; স্ক্র্যাপ -শিশি -বোতল -কাগজ কুড়োয়; গ্যারাজে, ছোটখাট লেদ বা রং কারখানায়, চায়ের দোকানে, ভাতের হোটেলে কাজ করে; রাজমিস্ত্রির কাজ করে; লোকের বাড়িতে ঠিকে কাজ করে; ওয়াগন ভাঙে; স্মাগলিং - খরচা হয়ে যায়; ভিক্ষে করে; স্কুল যায় না। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছেলে -মেয়ে নির্বিশেষে মাদকাশক্তি চাইল্ড প্রস্টিটিউশনের শিকার। গোয়ার হোটেলগুলিতে পুলিশ যে লোক -দেখানো রেড মারে, তাতে অধিকাংশ সময়ে দেশি -বিদেশি বুড়ো ভামেরা শিশুদের অ্যাডাল্টারেশনের দায়ে হাতে -নাতে ধরা পড়ে। আমাদের রিয়েলিটি শো -তে যে বাচ্চাগুলো বাবা -মা’র স্বপন সার্থক করতে ঘাম ঝরায়, তারাও তো বেসিক্যালি এক প্রকার শিশু শ্রমিক।
ইউনিসেফ জানাচ্ছে, সারা পৃথিবীতে যুদ্ধে গত দশকে মিলিয়ন শিশু নিহত, ৬ মিলিয়ন শিশু গৃহহারা, ১২ মিলিয়ন শিশু আহত প্রতিবন্ধী হয়েছে। আর . মিলিয়ন সশস্ত্র বালক -কিশোর দুনিয়ার ৮০টি দেশে যুদ্ধরত। এরা কখনও স্পাই, কখনও কুলি, কখনও রাঁধুনি, আবার কখনও সেনাদের ‘বউ’। হ্যাঁ, ছেলেরাই। কারণ, কিশোরীরা যুদ্ধে ব্রাত্যা। যখন সেনাবাহিনী লোকালয়ে ঢুকে পড়ে, কেবল তখনই ওদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। ১২ -১৪ বছরের মেয়েরা দ্রুত মা হয়ে যায়। আর এইচআইভি হলে তো কথাই নেই ! এই ছেলে -মেয়েরা নিজেদের চোখের সামনে নিজেদের ঘর পুড়তে দেখেছে, মা -বাবাকে খুন হতে দেখেছে, গুলিবৃষ্টির মাঝে কোনও রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে, খিদের জ্বালায় সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে অথবা জোর করে ওদের আর্মিতে জুুতে দেওয়া হয়েছে। এরা মূলত মাইন স্থাপন সেগুলি খালাসের কাজে ব্যবহৃত হয়, আর সামনের সারির সৈনিক হিসেবে শত্রুর প্রথম টার্গেট।
কম পক্ষে ৫০টি দেশের বাচ্চারা যুদ্ধের মধ্যে বড় হচ্ছে। কম্বোডিয়ায় গত ১৫ বছরে প্রায় মিলিয়ন শিশু নিজেদের মাটি থেকে উৎপাটিত। এই রকম ৯৬ জন ছেলে -মেয়ে যারা সারা ক্ষণ হিংসা, নৈরাজ্য চরম দারিদ্রের মধ্যে বড় হয়ে উঠছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা ধরেই নিয়েছে মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চোর, অসৎ হিংস্র অন্তত টিন -এজারদের তো তাই মত। ভাবা যায়, একটা গোটা প্রজন্ম এক চরম অবিশ্বাস আর তীব্র হিংসার মধ্যে বড় হচ্ছে ! সঙ্গে আছে খিদে, অপুষ্টি, অর্থাভাব, আশ্রয় নিরাপত্তাহীনতা, যৌন হেনস্থা এবং যখন তখন কোতল হওয়ার ভয়। একটা পরিসংখ্যান দিই : ১৯৯৫ পর্যন্ত, যুদ্ধ চলেছে আঙ্গোলায় ৩০ বছর, আফগানিস্তানে ১৭, শ্রীলঙ্কায় ১১, সোমালিয়ায় বছর।
কেউ সাদা গাউন, কেউ আলখাল্লা, কেউ ধুতি পরে জ্ঞান দেয়। বাচ্চাদের জন্যে এক লাইনও খরচ হয় না কোথাও। শাহবাগ ফেটে পড়ে। দলাই লামার নামে হুলিয়া বেরোয়। ঘরে -বাইরে ভোট হয়। কিন্তু কোনও পার্টির ম্যানিফেস্টোতে শিশুদের জন্য প্রতিশ্রুতি নেই। মাঝে মাঝে ইউনেস্কো, ইউনিসেফ বা ইউএনও লাফালাফি করে, মোটা টাকা স্যাংশন হয়, সাহেবরা রিসার্চে বেরোন, কিছু সদর্থক কাজ হয়তো হয়, কিন্তু গত মাসে সিরিয়ার বাচ্চাটার যে পা -টা উড়ে গেল, সেটা আর ফেরত আসে না।
লিখতে লিখতে সুয্যি প্রায় পাটে। জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যাচ্ছে, মায়ের পাশে স্কুল থেকে ফিরছে ক্লাস সিক্সের ছেলে। বিদ্যের বোঝায় নুয়ে গেছে পিঠ। শিরদাঁড়া বেঁকানোর আধুনিক প্র্যাকটিস। আজ বোধ হয় অঙ্কের ক্লাস টেস্ট ছিল। চোখ ছলছল। উত্তর মেলাতে -মেলাতে হতাশ মা ছেলেকে দু’ঘা দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছেন। আর বলছেন, ‘তোর জীবনে কিস্যু হবে না।’ আইনস্টাইনের কথা মনে পড়ল। তাঁর অঙ্ক শিক্ষকও তো তাঁকে এমনই কিছু একটা বলেছিলেন। সেই শিক্ষকের নাম কিন্তু ইতিহাস মনে রাখেনি।
আমাদের ছোট পরিসর, যন্ত্রণার সাইজ ছোট, কিন্তু তীব্রতা ছোট নয়। আজও মনে আছে, অঙ্ক পরীক্ষা খারাপ দিয়েছিলাম বলে মা সারা দিন না -খাইয়ে রেখেছিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.