রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
যৌবনবাউল
আমার প্রথম বই
য়ঃসন্ধিক্ষণের চৌকাঠ পেরিয়েও নিজের নামে কোনও বইপত্র প্রকাশ করার ব্যাপারে অপরিসীম কুণ্ঠা ছিল আমার। ‘শতভিষা’ কবিপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবার কারণও ছিল মঞ্চভীরু ধরন-ধারণ। এক দিন সম্পাদকীয় বৈঠকে প্রথম কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করার কথা উঠতেই আমার নিভৃতচারী বিবাগী বন্ধু আলোক সরকারকে বললাম: ‘আসুন না, এক সঙ্গে আমরা একটা বই প্রকাশ করি।’ দিন সাতেকের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে যুগলবন্দিতে সম্পন্ন হল ‘ভিনদেশী ফুল’(১৯৫৭), তা-ও স্বরচিত কবিতার সংকলন নয়, নির্বাচিত ফরাসি কবিতার অর্ঘ্যপ্রসূন!
সে দিক থেকে দেখলে ‘যৌবনবাউল’ (১৯৫৯) আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই নির্ধারণের মধ্যেও হয়তো এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাস রয়ে গেল। আমার বিনীত বিবেচনায় এই বইতে অন্তত দু-তিন পর্বাঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন মর্জির কবিতা মিলেমিশে আছে। আমার মনে হয়, অন্তত তিনটি বই এখানে পরপর অথবা আড়াআড়ি ওতপ্রোত। অল্প কথায় সে-সব পর্বান্তরের আভাস দিতে চাই।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের রেশ দক্ষিণ কলকাতায় খুব যে পৌঁছেছিল, এমনটা বলতে পারি না। কিন্তু জাপানি বোমাতঙ্কের গুজবটা ছড়াতেই বাবা আচমকা এক দিন মা’কে আর আমাকে সাঁওতাল পরগনার রিখিয়া বলে একটি গ্রামে এখন ঝাড়খন্ডের অন্তর্গত রেখে এলেন। বলা বাহুল্য, পিতামহ আমায় কাছে পেয়ে দারুণ খুশি। দিনাজপুরে প্রধান শিক্ষকতার কাজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি রিখিয়ায় একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের নিবিড় সহাবস্থানের উপযোগী বড় মনোরম একটি পরিসর গড়ে তুলেছিলেন। এখানেই অসংখ্য মানুষজনের সান্নিধ্যে গড়ে উঠল আমার আসল ভিটে। পুজোর সময় সুদূর গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে এসে কত যে ভাই-বেরাদর এক সঙ্গেই সেখানে বসবাস করতেন তার ইয়ত্তা নেই। বলতে লজ্জা নেই, দাদু অচিরেই আমার হাতে যখন পূজার ভার ন্যস্ত করে দিলেন, আমার সমগ্র সত্তাশরীর কেঁপে উঠেছিল।
ষষ্ঠীর ভোররাত্রে মা-দুর্গার পায়ে একশোটি স্থলপদ্ম নিবেদন না-করা পর্যন্ত স্বস্তি ছিল না আমার। সুতরাং, ‘যৌবনবাউল’ বইতে কবিতার সংখ্যা কেন মাঙ্গলিক ১০৮, তার বিশদ ব্যাখ্যার হয়তো দরকার নেই।
যৌবনবাউল ছেয়ে বড় বেশি ঐশ্বরিকতার প্রাদুর্ভাব, এক সময় অনেকেই এই অপবাদ জুগিয়েছেন। এমনকী আমার প্রতি একান্ত স্নেহশীল বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকা ‘কবিতা’য় এই মর্মে আমাকে অনাধুনিক আখ্যাও দেওয়া হয়েছে। আজ ভাবি, ‘ঈশ্বর’ কি তখন এক-এক বার কবিতার সপক্ষে আমার স্বকপোলকল্পিত একটি ‘নির্মিতি’ (construct) ছিলেন না? সম্প্রতি এ কথা অস্ট্রেলিয়ার মান্য কবি লুই মারে’কে বলতেই করজোড়ে আমায় বললেন: ‘আমি কিন্তু অলোকরঞ্জন, চিরকালই ঈশ্বরের নির্মিতি।’ আজ আমি পিছনের দিকে তাকিয়ে এটুকুই বলতে পারি, ভগবতী দুর্গার প্রায়-পৌত্তলিক উপাসক হওয়া সত্ত্বেও ঈশ্বরের প্রতি অমেরুদণ্ডী আনুগত্য তখনও আমার মজ্জাগত ছিল না। আজ যখন চূড়ান্ত নিরীশ্বর সমালোচকেরাও আমার সাম্প্রত কবিতায় ঈশ্বরের অনুপস্থিতি লক্ষ করে হাহাকার করে ওঠেন, তাঁদের আমি ওই বইটি আর এক বার পড়ে নিতে অনুরোধ করতেই পারি।
রিখিয়া জুড়ে ছিল ভূত-প্রেতেরও মেলা। এক-একটি তুলসীতলার মতো ক্ষুদ্র দেবায়তনের গা ঘেঁষে কীর্ণ হয়ে ছিল অঙ্কিত কৌমতান্ত্রিক নানান চিহ্ন। এক দিন দেখি, সেই প্রেতায়িত পল্লি-প্রান্তিকে বিবাহ উৎসবের প্রস্তুতি, লগ্ন আসন্ন, এক জন পুরোহিতও এসে হাজির, শুধু কিনা পাত্রীরই পাত্তা নেই। বিবাহকাতর যুবকটিকে জিজ্ঞেস করি: ‘কী রে মংলা, কনে কই!’ প্রত্যুত্তরে সে যা বলতে চাইল, তার মর্মার্থ হচ্ছে, কন্যা এখনও অনির্ণীতা। ‘যৌবনবাউল’-এর অধিকাংশ কবিতাই এই বক্তব্যের আলোয় দেখলে, অন্ধকার ও অমীমাংসার শামিল, যা এর পরের প্রকাশিত বই ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী-তে (১৯৬৮) আরও উচ্চারিত।
রিখিয়া থেকে, আমার দশ-এগারো বছর বয়েসের মুখে, শান্তিনিকেতনে পাঠভবনের শিক্ষার্থী হয়ে যাত্রা অবশ্যই আর একটি পর্বন্যাস। এই আনপড়ুয়াকে আম্রকুঞ্জের মুক্ত অঙ্গনে ক্লাস নিতে-নিতে নির্মলদা (বিশ্বসাহিত্যের ভিতরবাসী মানুষ নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) আমার কাছে beautiful শব্দটার সঠিক বানান জানতে চাইলে আমি যেই দৈবক্রমে নির্ভুল উত্তর জ্ঞাপন করি, সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমায় ক্লাস সিক্সে উন্নীত করে নেন। তখন থেকেই আমি সেই সুন্দরের অন্ধ ভক্ত, যিনি এই জন্মে আমার জন্মজন্মান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন। কে এই সুন্দর? আর যিনিই হোন, মসৃণ কোনও সংঘটন নন। শান্তিনিকেতনে ছাত্রদশাতেই মার্ক্সবাদে অকালদীক্ষিত হয়ে পড়ি, ঘন ঘন কলকাতায় যাওয়া-আসা সূচিত হয়, সেই সুবাদে বীরভূমের গ্রামেগঞ্জেও শুরু হয়ে যায় আমার ঘুরে বেড়ানো। কার্ল মার্ক্সের সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে একটি লেখায় হাত দিয়েছি শুনে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা আমায় এই বলে ধিক্কার দেয় যে, নন্দনতত্ত্ব কার্ল মার্ক্সের এলাকা-বহির্ভূত। অতএব আমি যেন অনধিকার চর্চা থেকে বিরত হই। এই সব বিতর্ক-ভাবনার ভিতরদ্যোতনা এক কথায় বন্ধুদের সঙ্গে আমার এই মেঘ এই রৌদ্র যৌবনবাউলেই বীজাঙ্কুরিত হয়ে দশ বছর পরে প্রকাশিত ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’য় (১৯৬৯) স্পষ্টতর আকার নিয়েছে বলে আমার ধারণা। সব মিলিয়ে রিখিয়া-শান্তিনিকেতন-কলকাতার ত্রিমুখী আবর্ত ‘যৌবনবাউল’ শীর্ষাঙ্কিত গ্রন্থের গহন গ্রন্থি হয়তো।
বিশ্বভারতী তখনও ছিল এল ডোরাডো, যেখানে স্বপ্ন এবং সত্য অথবা জীবন ও শিল্পের মধ্যে কোনও বিভাজনরেখা ছিল না। সাজঘরের ভিতরকার সাজসরঞ্জাম প্রত্যক্ষ করে পরক্ষণেই নাটকের চরিত্র বা দর্শক হয়ে নেমে পড়াটার মধ্যে কোনও স্বতন্ত্র বাহাদুরি ছিল না। স্পষ্টই মনে পড়ে, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু তথা আমাদের হাতের কাছেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অথচ অনারোহ আমাদের মাস্টারমশাই ‘রাজা’ রূপকের দলবলকে নিজের হাতে সাজিয়ে লাইব্রেরির বারান্দায় মঞ্চায়নের উদ্দেশে রওনা করে দিচ্ছেন, সমূহ কুশীলবের দিকে আশীর্বাদে উত্থিত তাঁর হাত, রথের উপরে আসীন বর্ণাঢ্য প্রসাধনে শোভিত লোকনাথদা (তখনই তিনি সর্বজনবিদিত কবি: লোকনাথ ভট্টাচার্য), নকল রাজার ভূমিকায় তাঁকে চেহারায় দুর্ধর্ষ মনোরম্যতা থাকা সত্ত্বেও অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে কেমন! তাঁর হাতে একটা নোটবই। কেন, প্রশ্ন করতেই তিনি সপ্রতিভ স্বরায়ণে বললেন, ‘কবিতার এক-একটা লাইন মাথায় এসে যেতে পারে ভেবেই খাতাটা সঙ্গে রেখেছিলাম।’ আজকের শান্তিনিকেতনে এ রকম স্বর্গীয় দৃশ্য কল্পনাই করা যায় না। সে-দিনকার আশ্রমে কিন্তু এইটেই ছিল স্বাভাবিক, শিল্প থেকে শিল্পে অনায়াস সঞ্চরমাণ হওয়ার এই অগাধ স্বাধীনতা। তার ফলে জীবন হয়ে উঠত শিল্প, এ দুয়ের মধ্যে কোনও ফারাক ছিল না একেবারেই। কিন্তু মুশকিলটা ছিল এই যে, শিল্পচেতনাকে আলাদা করে শনাক্ত করা যেত না। চেস্টরটনই না বলেছিলেন, ফ্রেম না থাকলে ছবি হয় না!
সেই ফ্রেমটা আমি যেন পেয়ে গেলাম কলকাতায়। সেন্ট জেভিয়ার্সে মিশনারি শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত গ্রন্থাগারে প্রবেশাধিকার পেয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকতাম নন্দনতত্ত্বের বহুবিধ সন্দর্ভ সমাচার। দিনের শেষে এক-এক সময় উঠে আসত দুয়েকটা চিত্রকল্প, স্মৃতি থেকে সাজিয়েগুছিয়ে রাখতাম। যৌবনবাউলের মধ্যপর্যায় থেকে সূচিত কবিতাগুলির ভিতরে তাই বুঝি বিন্যাসপনার দিকে ঝোঁক ঈষদুগ্র। বইটা লেখা হয়ে গেলে রবীন্দ্রায়ণের তীর্থংকর পুলিনবিহারী সেনের হাত দিয়ে উৎসর্গ করার অনুমতি প্রার্থনা করে লিখতেই ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন: ‘সানন্দে সম্মত।’ এ রকম কিংবদন্তিময় নানান অনুষঙ্গের জন্যেই বোধহয় এ বইয়ের গায়ে কেমন যেন ‘চিরায়ত’ একটা সিলমোহর পড়ে গেছে। আত্মদেবায়নের দায়ে বিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও তাই এই স্বগতকথনের নাম দিলাম: প্রথম আদি...


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.