সেই গিন্নিটিকে মনে আছে, যিনি প্রতি দিন স্বামী বাড়ি ফেরার পর তাঁর জামাকাপড়ে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালাতেন, যদি কোনও মেয়ের চুলের সন্ধান পাওয়া যায়? বহু দিন খোঁজার পরেও যখন কিচ্ছু পাওয়া গেল না, গিন্নি বললেন, ‘ছি ছি, তোমার এত অধঃপতন হয়েছে যে টেকো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছ?’
গিন্নির সঙ্গে ড্যানিয়েল কানেম্যান-এর দেখা হলে তিনি জানতেন, মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায় তাঁকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কানেম্যান প্রিন্সটনে মনস্তত্ত্বের প্রফেসর ইমেরিটাস। নোবেল পেয়েছিলেন ২০০২ সালে। তিনি বলেছেন, গল্পের গিন্নির মতো আমরাও আমাদের প্রাথমিক বিশ্বাসের পক্ষে ‘প্রমাণ’ খুঁজে বের করতে রীতিমত দক্ষ। তেমনই দক্ষ বিশ্বাসের বিপক্ষের প্রমাণ অগ্রাহ্য করতে।
কানেম্যান তাঁর ‘থিঙ্কিং ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’ বইটিতে একটা পরীক্ষার কথা বলেছেন। বেশ কয়েক জন লোককে বেছে নিয়ে দু’দলে ভাগ করা হল। দু’দলকেই আলাদা ভাবে একটা ছবি দেখানো হবে। প্রথম দলকে দেখানো হবে একই ছবির দশটা স্লাইড প্রথমটা একেবারে অস্পষ্ট, তার পর ক্রমে স্পষ্ট হতে হতে দশ নম্বর স্লাইডে এসে মোটামুটি স্পষ্ট। দ্বিতীয় দলকে দেখানো হবে পাঁচটা স্লাইড প্রথম দলকে যে দশটা দেখানো হয়েছিল, তার শেষ পাঁচটা। শেষে দু’দলকেই বলতে হবে, কীসের ছবি দেখলেন তাঁরা।
কোন দলের বেশি লোক ঠিক উত্তর দিয়েছিলেন? আন্দাজ বলবে, প্রথম দল। কারণ ছবিটা তাঁদের সামনে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে। আসলে কিন্তু দ্বিতীয় দলের তুলনায় প্রথম দলের ঠিক উত্তরদাতার সংখ্যা অনেক কম। কারণ? প্রথম দলের লোকরা একেবারে অস্পষ্ট অবস্থায় ছবি দেখেছিলেন, এবং সেই ছবিটি দেখেই তাঁরা ছবির আন্দাজ করতে আরম্ভ করেছিলেন। তার পর ছবি যত স্পষ্ট হয়েছে, তাঁরা নিজেদের আন্দাজের পক্ষে ‘প্রমাণ’ খুঁজে নিয়েছেন। মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় এই ঘটনাটার নাম হল ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বাংলায়, ‘বিশ্বাসের ঠুলি’। |
যেমন ধরুন, আকাশে মেঘ জমলে নাকি বাতের ব্যথা বাড়ে। যদি বলি, এটা একটা আষাঢ়ে বিশ্বাস অমনি অনেকেই তেড়ে আসবেন। বলবেন, নিজে দেখেছি, মেঘলা দিনে ব্যথা বাড়ে। দেখেছেন তাঁরা ঠিকই, কিন্তু আধখানা দেখেছেন। যে দিন আকাশে মেঘ আর তাঁদের গায়ে ব্যথা সে দিনটা তাঁদের মনে থেকে গিয়েছে। আবার, যে দিন আকাশ ঝকঝকে, শরীরও ব্যথাহীন, সে দিনটাও মনে আছে। কিন্তু আকাশে মেঘ অথচ শরীরে ব্যথা নেই, এবং শরীরে ব্যথা কিন্তু আকাশে মেঘ নেই এই দুই ধরনের দিনের কথা তাঁদের মন বেমালুম ভুলে গিয়েছে। তাঁদের বিশ্বাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে মন বেছেবুছে প্রমাণ তুলে রেখেছে। বহু তুকতাক, সংস্কারের পিছনের কারণ এটাই। মানুষের মাথা আসলে একটা গল্প বানানোর যন্ত্র। আমাদের মন গোড়ায় একটা বিশ্বাস স্থির করে নেয়, তার পর সেই বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি খাড়া করে একটা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ গল্প তৈরি করে।
এই যে পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাসের বাইরে আর কিছু দেখতে না পাওয়া, এটা মনের চোখে পাকাপাকি ভাবে ফেট্টি বেঁধে রাখা। ভাবার চেষ্টা করুন তো, চোখে ফেট্টি বেঁধে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন! শিউরে উঠলেন? আপনার মনের ‘গল্প বানানোর মেশিন’ কিন্তু আপনাকে দিয়ে এই কাজটাই করাচ্ছে অনিশ্চয়তায় ভরা দুনিয়ায় আপনাকে মনগড়া গল্পের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।
উপরন্তু, আমরা সাধারণত একটা ‘একো চেম্বার’-এ বাস করি। অর্থাৎ, আমরা তাঁদের সঙ্গেই বেশি মিশি, বেশি সময় কাটাই, বেশি আলোচনা করি যাঁরা আমাদের মতো। আমরা যে কথা বিশ্বাস করি, তাঁরাও সেই কথাই বিশ্বাস করেন। আমরা যখন কথা বলি, একই কথা বলি। গত কাল আমি আপনার থেকে যে কথাটা শুনেছিলাম, তখন যেহেতু সে কথাটা আমি বিশ্বাস করেছিলাম আজ আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় সে কথাটাই নিজের কথা হিসেবে বলি। আপনি এক দিনের ব্যবধানে নিজের কথাই শোনেন, কিন্তু ভাবেন, সবাই এ রকম বলছে। অনেকে এক সঙ্গে এই ভাবে একে অপরকে বিশ্বাস জোগালে ও বিশ্বাস করলে একটা বিশ্বাসই ঘুরতে থাকে তার বাস্তব ভিত্তি না থাকলেও।
এর ফলে কী মারাত্মক বিপদ হতে পারে, তার প্রমাণ ২০০৮ সালের মার্কিন সাবপ্রাইম মর্টগেজ ক্রাইসিস। সে দেশে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক তখন বাড়ি কেনার জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে আরম্ভ করেছিল। কারণ, বাড়ির বাজারে দাম দারুণ ভাবে বাড়ছিল। সেই বাজারে ঋণ দেওয়ার পরিমাণও বাড়িয়েছিল ব্যাঙ্কগুলো, কারণ প্রত্যেক ব্যাঙ্কারই বিশ্বাস করছিলেন যে দাম আরও বাড়বে। এই ঋণের ঋণপত্রের ভিত্তিতে এক ব্যাঙ্ক ঋণ দিচ্ছিল আর এক ব্যাঙ্ককে। পুরো লেনদেনটাই দাঁড়িয়ে ছিল একটা বিশ্বাসের ওপর এই ঋণের মার নেই। যাঁরা বিশ্বাস করছিলেন এই কথায় বস্তুত সবাই, যাঁরা এই ব্যবসায় জড়িত তাঁরা আসলে একে অপরের কথায় নিজেদের বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনছিলেন। শেষে এই ঋণের বাজার ভেঙে পড়ল, কারণ এখানে বিশ্বাসই ছিল, বিশ্বাসের বাস্তব ভিত্তি ছিল না।
আর এক মোক্ষম উদাহরণের দশ বছর পূর্ণ হচ্ছে ২০১৩ সালে। ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধানে মার্কিন অভিযানের। এই যুদ্ধের কার্যকারণের মধ্যে যেতে চাই না। আমেরিকা নানান অজুহাতে অনেক যুদ্ধ করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু ইরাকে যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি, সে কথা পরে মার্কিন প্রশাসনও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এ কথা রাষ্ট্রপুঞ্জের অস্ত্র পরিদর্শকরা ২০০৩ সালের মার্চেই বলেছিলেন কিন্তু তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিজেদের গোয়েন্দা বিভাগের তৈরি করা ভ্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে বুশ রণদাদামা বাজিয়ে দিলেন। এই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের গল্পটি মার্কিন প্রশাসনের সবাই যে বিশ্বাস করেছিলেন, তা নয়। তবে এটুকু বলাই যায় যে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালানোর সময় যে বক্তব্যের ওপর মার্কিন প্রশাসন এতখানি জোর দিয়েছিল, সেই বক্তব্য পরবর্তী কালে এমন শোচনীয় ভাবে সর্বসমক্ষে মিথ্যা প্রমাণিত হবে জানলে হয়তো তাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ের কৌশল পাল্টাতেন। অর্থাৎ, এখানে কনফার্মেশন বায়াসের কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
হয়তো মার্কিন ব্যাঙ্কিং দুনিয়াতে কারও কারও মনে সন্দেহ ছিল, যেটা চলছে তার বাস্তব ভিত্তি নেই। হয়তো মার্কিন প্রশাসনেও কেউ ভেবেছিলেন, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের গুজবটা খতিয়ে দেখা ভাল। কিন্তু যেখানে সবাই এক কথা বলছে, একই মতে বিশ্বাস করছে, সেখানে উল্টো কথা বলার বিপদ অনেক। কাজেই, ‘বুদ্ধিমান’ লোক এমন পরিস্থিতিতে নিজের মতটি চেপে যান। প্রচলিত মতের পক্ষেই কথা বলতে থাকেন। এই প্রবণতার নাম হল ‘কনফর্মিজম বায়াস’। ভিন্ন মতকে চেপে রেখে এই প্রবণতা কনফার্মেশন বায়াসের পথ আরও প্রশস্ত করে দেয়।
কনফার্মেশন বায়াস থেকে তৈরি হতে পারে ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন। কনফার্মেশন বায়াস আমাদের তথ্য বাছাই করতে বাধ্য করে তাতে অনেক জরুরি তথ্য, আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না বলে, ছাঁটাই হয়ে যায়; আর অনেক বিভ্রান্তিকর ‘তথ্য’ ঢুকে পড়ে আমাদের মনে। তার প্রত্যক্ষ ফল, সমাজের মধ্যে মতামতের দুটো ভিন্ন মেরু তৈরি হয়ে যায়। এক মেরু অপর মেরুর যাবতীয় বিশ্বাসকেই সন্দেহের চোখে দেখে, অপর মেরুর বিশ্বাসের সঙ্গে যে তথ্য খাপ খায়, তাকে শুধু সেই কারণেই নিজের মনে ঢুকতে দেয় না। যাঁরা জানেন বা বোঝেন, তাঁরা চুপ করে যান ‘আমরা-ওরা’র কোলাহলে হারিয়ে যায় উন্নয়নের দিশা।
|
মৈত্রীশ ঘটক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এ অর্থনীতির শিক্ষক |