কিছু দিন পূর্বে অকস্মাৎ সমগ্র পৃথিবী জুড়িয়া ইন্টারনেট অতিশয় ধীর হইয়া পড়িল, কিছু কম্পিউটার-দুষ্কৃতী আন্তর্জালে কিছু স্প্যাম ঢুকাইয়া এই কাণ্ড করিয়াছিল। এই মুহূর্তে আন্তর্জালের উপর নির্ভর করিয়া এই গ্রহ মহা ঘনঘটায় পাক খাইতেছে, লোকে প্রেম, কাম, ব্যবসায়, সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র উপভোগের জন্য ইহারই উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। লেখাপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, তথ্য-পরিসংখ্যান, ধারণা-প্রয়োগ, সিন্দুকের বদলে কম্পিউটারেই সংরক্ষিত থাকে, আন্তর্জালের মাধ্যমে সরবরাহ হয়। বহু মানুষ নিজ পিতৃনাম জানিতেও এক বার চট করিয়া সার্চ ইঞ্জিনকে জিজ্ঞাসা করিয়া লয়। বিশ্বের অধিকাংশ সাক্ষর মনুষ্যই আজ গুগ্ল ব্যতীত নিতান্ত খঞ্জ, উইকিপিডিয়া-র জ্ঞানভাণ্ডার সরাইয়া লইলে পরীক্ষার হলে টুকিবার কুচি-কাগজ-হৃত ছাত্রের ন্যায় অসহায় ও রোদনোন্মুখ। আর ব্যাঙ্ক তো পইপই করিয়া বলিতেছেই, কেহ আমাদিগের বাস্তব শাখায় হাঁটিয়া আসিবেন না, যাবতীয় লেনদেন ভার্চুয়াল প্রকারে সারিয়া লউন। এমন দিন দূরে নাই, যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র কম্পিউটারে হোমওয়ার্ক সারিয়া, শিক্ষকের নিকট মেল করিয়া পাঠাইয়া দিবে, শিক্ষকও বৃহৎ গোল্লা কম্পিউটারেই আঁকিয়া মেল করিবেন। ফলে স্প্যামের হুড়া খাইয়াই হউক, আর অতিকায় আধিদৈবিক বায়সের চঞ্চুর আঘাতে উপগ্রহ-পতনেই হউক, যদি আন্তর্জালের কেরামতি সহসা বন্ধ হইয়া যায়, পৃথিবী চক্ষে অন্ধকার দেখিবে। যে দিন হইতে মানুষের প্রকাণ্ড সুবিধা করিয়া দিবার জন্য এই জগৎ জোড়া জাল বয়ন শুরু হইয়াছে, সেই রাত্রি হইতেই এই জাল বিনষ্ট করিবার মতলবেরও সূচনা। অশুভ গণিত-মস্তানরা এক দিন সফল হইবে, ইহাই স্বাভাবিক।
আন্তর্জাল এমন প্রবল প্লাবনের ন্যায় জীবনে ওতপ্রোত সংলগ্ন হয় নাই, এমন দিন আজ প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়, কিন্তু আট-দশ বৎসর পূর্বেও ভারতে আন্তর্জালের প্রভাব ছিল নগণ্য। এখনও অধিকাংশ মানুষের কম্পিউটার-ব্যবহারের সুযোগই নাই, যাহাদের আছে তাহারাও ইহার অভ্যাসকে যত গুরুত্বের সহিত দেখিয়া থাকে, তাহা নিতান্ত আত্মপ্রবঞ্চনা। আন্তর্জাল মূলত তাহাদিগের আলস্যের স্যাঙাত। হাঁটিয়া ব্যাঙ্কে যাওয়া ভয়াবহ শ্রমসাধ্য নহে, সর্ব প্রশ্নের উত্তরের জন্য মহাসিধুজ্যাঠার শরণ লওয়ার অভ্যাস স্বাস্থ্যকর নহে, নিজ জ্ঞান সংগ্রহের অভ্যাসকে উহা লুপ্ত করিয়া দেয়। ফিল্ম ও সংগীতের বড় কোম্পানিগুলিকে ঠকাইয়া বিনিপয়সায় শিল্প-ভোগ করিবার প্রবণতা তো অতীব অন্যায়। সাধারণ মানুষের জীবনে আন্তর্জাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীতিহীনতা বা উদ্যমহীনতাকে প্রশ্রয় দিয়া চলিতেছে। সেই জন্যই ইহার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও স্ফীত মূল্যায়ন। সমগ্র দিন নিজ কাজ হইতে মুখ সরাইয়া ফাঁকি মারিবার সহস্র উপকরণ ইহা সম্মুখে সাজাইয়া দেয়, আমরা অফিসে বসিয়া সম্পূর্ণ অবান্তর আমোদ-সাইট ঘাঁটিয়া সময় ফুরাইয়া ফেলি। বরং এই সম্মোহন সহসা সরিয়া গেলে আমরা পুনর্বার আকাশের বর্ণ কী সেই বিষয়ে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ চালাইতে পারিব। সত্যই যদি এক অলীক সকালে হ্যাকাররা আশ্চর্য কারিকুরি করিয়া জাল ফাঁসাইয়া দেয়, পিঞ্জরের স্বস্তিতে অভ্যস্ত পক্ষীকে চকিতে আকাশে ছুড়িলে সে যেমন ভীত আড়ষ্ট হইয়া পড়ে, গোড়ায় তেমন হাহাকার করিয়া দিগন্ত ফাটাইব, অনতি-পরে নিজ হাতেপায়ে কাজ করিবার স্বাধীনতা আমাদিগের ডানায় স্বাভাবিকতার উল্লাস আনিয়া দিবে! |