এক দিকে ব্লাডব্যাগের ভয়াবহ আকাল, অন্য দিকে রক্তদান শিবিরে যাওয়ার জন্য সরকারি গাড়ির অভাব দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে প্রায় এক মাস যাবৎ রাজ্যে রক্তসংগ্রহ প্রক্রিয়া থমকে যেতে বসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গরমে প্রত্যেক বারের মতো এ বারও রক্তসঙ্কট রয়েছে। তার মধ্যে এই যৌথ আকালে পরিস্থিতি কী ভাবে সামলানো যাবে, বুঝে উঠতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা।
অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে স্বাস্থ্যকর্তারাই জানিয়েছেন, রাজ্যে যেখানে মাসে প্রায় ৬০ হাজার ব্লাডব্যাগ লাগে, সেখানে এই মুহূর্তে রয়েছে ১০ হাজার! একের পর এক রক্তদান শিবির শুধু ব্লাডব্যাগের অভাবে বাতিল হচ্ছে। রক্ত নিরাপত্তা বিভাগের এক শীর্ষকর্তা বলেছেন, “২০১২-১৩ সালের জন্য জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ন্যাকো) এখনও একটাও ব্লাডব্যাগ পাঠায়নি। চিঠি দিয়ে আমরা ক্লান্ত। ন্যাকো জানিয়েছে, ৩০ মার্চ ৮৫ হাজার ব্লাডব্যাগ পাঠাবে। যদি সেটা না আসে, তা হলে গোটা রাজ্যে রক্তদান শিবির আর রক্তসংগ্রহ প্রক্রিয়া পুরোপুরি থমকে যাবে।”
স্বাস্থ্যকর্তারা হিসেব দিয়ে জানান, ২৬ মার্চ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের হাতে সাকুল্যে দেড় হাজার সিঙ্গল ব্লাডব্যাগ ছিল! এ রকম অবস্থা নিকট অতীতে কখনও হয়েছে বলে তাঁদের মনে পড়ছে না। ডবল ব্লাডব্যাগ রয়েছে হাজার তিনেক, ট্রিপল ব্যাগ হাজার চারেক। তাঁদের কথায়, “বহু জেলায় রক্তদান শিবির প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে। ডবল-ট্রিপল ব্যাগের অভাবে অনেক মেডিক্যাল কলেজে রক্ত পৃথকীকরণও থমকে যাওয়ার মুখে।
এমন অবস্থা হল কী করে?
স্বাস্থ্যকর্তাদের জবাব, “ন্যাকো ব্যাগ না পাঠালে আমরা অসহায়। আমাদের এই ব্যাগ কেনার অধিকার নেই।” ন্যাকোর মুখপাত্রের বক্তব্য, “রাজ্য ঠিক সময়ে ব্লাডব্যাগ চায়নি বলে এই অবস্থা। পশ্চিমবঙ্গের এই অবস্থা দেখে জরুরি ভিত্তিতে প্রথমে ১৫ হাজার, তার পর ৮৫ হাজার ব্যাগ পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
শুধু ব্লাডব্যাগই নয়, শিবির থেকে রক্তসংগ্রহ করতে যাওয়ার সরকারি গাড়ির অভাবে এই প্রথম নজিরবিহীন সমস্যায় পড়েছে সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কগুলি। এই ব্লাডব্যাঙ্কগুলিকে বিভিন্ন রক্তদান শিবিরে যাওয়ার গাড়ি দেয় স্বাস্থ্য দফতরের অন্তর্গত ‘স্টেট হেল্থ ট্রান্সপোর্ট অর্গানাইজেশন।’ তাদের গাড়ি নিয়ে হঠাৎ এই সমস্যার কারণ কী? স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের অভিযোগ চলতি মাসের প্রথম দিকে অডিট রিপোর্টে হেল্থ ট্রান্সপোর্টের বহু গাড়ির মিটারে কারচুপি ধরা পড়ে। এর ফলে অনেক চালক অন্যায় ভাবে যে অতিরিক্ত টাকা রোজগার করছিলেন, তা বন্ধ হয়ে যায়। এতেই তাঁদের অনেকে শিবিরে যাবেন না বলে বেঁকে বসেছেন। স্টেট হেল্থ ট্রান্সপোর্ট অর্গানাইজেশন কর্তৃপক্ষের আবার দাবি দুর্নীতি-টুর্নীতি বাজে কথা। আসল সমস্যাটা হল, গাড়িচালকের আকাল। এক কর্তার কথায়, “৮৫ জন চালক দরকার। রয়েছে ৩৫ জন। এই মাসে আরও ২ জন অবসর নেবেন। সরকার বহু দিন লোক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শনি-রবিবার অনেক রক্তদান শিবির হয়। চালকদের তো সপ্তাহে এক দিন ছুটি দিতে হবে!” পরপর গাড়ি বাতিল হওয়ায় কী ভাবে ধাক্কা খাচ্ছে শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহের কাজ?
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, গত ৮ মার্চ দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোচরণের শিবির থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের রক্ত সংগ্রহ করার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে তাদের গাড়ি বাতিল হয়। কোনও মতে অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে চিকিৎসকেরা শিবিরে পৌঁছন দুপুর ১টা নাগাদ। দেরির জন্য ১২৫ রক্তদাতার মধ্যে মাত্র ৮০ জনের রক্ত নেওয়া গিয়েছিল। ১০ মার্চ এসএসকেএম থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে যাওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ বারাসতে। গাড়ি না আসায় পৌঁছতে এত দেরি হয় যে ১২০ জনের মধ্যে মাত্র ৪২ জনের রক্ত নেওয়া গিয়েছিল। একই ভাবে সরকারি গাড়ি না পেয়ে ১৬ মার্চ বসিরহাটের শিবিরে কেন্দ্রীয় ব্লাডব্যাঙ্কের চিকিৎসকেরা অনেক দেরিতে যান। সেখানে মাত্র ১০০ জনের রক্ত নেওয়া গিয়েছে। অথচ ১৫০ জনের রক্ত দেওয়ার কথা ছিল। এসএসকেএম-কেও গাড়ি দেওয়া হয়নি। একই দিনে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ গাড়ির অভাবে এত দেরিতে নোনাডাঙা শিবিরে পৌঁছন যে মাত্র ৮ জনের রক্ত নেওয়া যায়।
১৭ মার্চ ৬টি সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে মোট ৮টি গাড়ি বাতিল করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্লাডব্যাঙ্কে ২টি, নীলরতনে ১টি, এসএসকেএমে ১টি, আরজি করে ২টি, ন্যাশন্যালে ১টি ও মেডিক্যাল কলেজে ১টি গাড়ি বাতিল হয়। ২২ তারিখ ন্যাশনাল মেডিক্যালে, ২৩মার্চ এসএসকেএম হাসপাতালকে এবং ২৪ মার্চ ন্যাশনাল ও এসএসকেএম-কে রক্তদান শিবিরে যাওয়ার জন্য গাড়ি দেয়নি স্টেট হেলথ ট্রান্সপোর্ট অর্গানাইজেশন। |