জেলায় জেলায় সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) খুলেও যে শিশুমৃত্যুর হার বলার মতো কমানো যায়নি, রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা তা মেনে নিয়েছেন। এবং এর মূল কারণ যে নিয়ন্ত্রণের অভাব ও পারস্পরিক সমন্বয়ের ঘাটতি, স্বাস্থ্য দফতরের নিজস্ব সমীক্ষায় তা-ও ধরা পড়েছে। সেই ত্রুটি শুধরোতে এ বার বিশেষ সফ্টওয়্যারের সাহায্যে সমস্ত এসএনসিইউ-কে এক ছাতার তলায় আনতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার।
সরকারি সূত্রের খবর: কলকাতার স্বাস্থ্য ভবন থেকে প্রতিটি এসএনসিইউয়ের উপরে সরাসরি নজরদারি চালাতে সাহায্য করবে ওই সফ্টওয়্যার। এমনকী, তার দৌলতে বাড়ির লোকও ইন্টারনেট মারফত সদ্যোজাতের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন বলে স্বাস্থ্য-সূত্রের দাবি। “প্রতিটি এসএনসিইউয়ে ভর্তি হওয়া প্রতিটি শিশু ও তার মায়ের যাবতীয় তথ্য মজুত থাকবে কম্পিউটারে। সেই তথ্যভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য এক ঝলকে পাওয়া যাবে।” বলেন এক স্বাস্থ্য-কর্তা।
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলায় সদ্যোজাতদের চিকিৎসার জন্য অন্তত একটি স্বতন্ত্র ইউনিট (এসএনসিইউ) চালু করার কথা বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার, যেখানে নানা ধরনের জটিল অসুখে আক্রান্ত বাচ্চাদের রাখা যাবে। কথা রয়েছে, প্রতিটি জেলা হাসপাতালে ১২টি থেকে ১৬টি শয্যা নিয়ে এসএনসিইউ চালু হবে। ২০১০-১১ অর্থবর্ষে রাজ্যে মোট ২৩টি এসএনসিইউ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তদানীন্তন বাম সরকার। পালাবদলের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে।
কিন্তু একের পর এক এসএনসিইউ খোলা হলেও সেগুলো কতটা সফল ভাবে কাজ করছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ, এসএনসিইউ চালু হওয়ার পরেও রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার কমছে না। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য এ বার এসএনসিইউগুলোর উপরে নজরদারি চালাতে সুসংহত একটি সফ্টওয়্যার তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা কী ভাবে কাজ করবে?
স্বাস্থ্য দফতরের খবর: নতুন প্রক্রিয়া চালু হলে কোনও সদ্যোজাত এসএনসিইউয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার ও মায়ের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে কম্পিউটারে নথিবদ্ধ হবে। কোথা থেকে, কী ধরনের অসুস্থতা নিয়ে শিশুটি এসেছে, সেই সব তথ্য বিস্তারিত ভাবে মজুত রাখা হবে। প্রতিটি এসএনসিইউয়ের পরিকাঠামোগত অবস্থাও জানা যাবে ঘরে বসে, স্রেফ মাউসের ক্লিকে। রাজ্যের তরফে তথ্য সংগ্রাহক তথা এসএসকেএমের শিশু-চিকিৎসক অংশুমান পারিয়ার কথায়, “তথ্য এমন ভাবে আসা দরকার, যাতে তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। নতুন সফ্টওয়্যারে সে ভাবেই তথ্য সরবরাহ করা হবে।” তাঁর বক্তব্য, অনেক সময়ে শিশু রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে দেখা যায়, একটাও শয্যা ফাঁকা নেই। নতুন ব্যবস্থায় জানা যাবে, তখন কোথায় এসএনসিইউয়ে বেড খালি আছে।
পাশাপাশি নতুন বন্দোবস্তে দায় এড়ানোর প্রবণতাও কিছুটা ঠেকানো যাবে বলে কর্তাদের আশা। কী ভাবে?
এক কর্তার ব্যাখ্যা, “বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে সদ্যোজাতের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দায়িত্ব খালাস করতে শিশুটিকে চটজলদি কাছের এসএনসিইউয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ার ঠিকঠাক তথ্য পাওয়া যায় না। নতুন সফ্টওয়্যারের সাহায্যে সেই তথ্যও সহজে মিলবে। শিশুটি মারা গেলে বোঝা যাবে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের গাফিলতি ঠিক কতটা দায়ী।” তিনি আরও বলেন, “ওই তথ্যভাণ্ডারের সাহায্যে কোনও একটি হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণ করে সহজে ধরা যাবে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট কোনও রোগের প্রকোপ বাড়ছে কি না, কিংবা বিশেষ কোনও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কি না। সেই মতো দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।”
কিন্তু এ সব পরিকল্পনা ঠিকঠাক বাস্তবায়িত হবে তো? ঘটনা হল, এর আগে রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নততর করতে বিস্তর প্রকল্প ঘোষিত হলেও তার অধিকাংশ খাতায়-কলমে রয়ে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তেমন হবে কি না, সেই প্রশ্ন স্বভাবতই মাথা চাড়া দিচ্ছে। কী বলছেন কর্তারা?
রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য নেতিবাচক সম্ভাবনাকে আমল দিচ্ছেন না। তাঁর দাবি: সব কিছু ভাল ভাবে যাচাই করে তবেই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। “কেন্দ্রীয় সরকারও ইতিমধ্যে এমন একটি সফ্টওয়্যার বানিয়েছে। আমরা সেটাকেও ভাবনার মধ্যে রেখেছি। চটজলদি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। দেখা হচ্ছে, ব্যবস্থাটা যাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত হয়। নতুন প্রক্রিয়ায় রাজ্যের বেশ ক’টা এসএনসিইউ কেন্দ্রে তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজ শুরুও হয়ে গিয়েছে।” বলেন ত্রিদিববাবু। সংশ্লিষ্ট সফ্টওয়্যার সংস্থার তরফে সুদীপ পালিত জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে প্রায় তিন হাজার রোগীর তথ্য এসে গিয়েছে। |