দিন নিয়ে আপত্তি, কমিশন অনড় কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রশ্নেও
দোলের আগের সন্ধ্যায় মনে হচ্ছিল, দমবন্ধ পরিবেশ বোধহয় কিছুটা হলেও সহজ হয়েছে। রংয়ের উৎসব ফুরোতেই বোঝা গেল, অবস্থা কিছুই বদলায়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত দফতরে চিঠি পাঠিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিল, মঙ্গলবার যে দু’দিন পঞ্চায়েত ভোট হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে পঞ্চায়েত দফতর, সেই দু’দিনে ভোট করা সম্ভব নয়। কমিশনের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা না-করেই এই দিন ঘোষণা করা হয়েছে। যা পঞ্চায়েত নির্বাচন আইন ২০০৩-এর পরিপন্থী। সেই সঙ্গে ভোটের সময় ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে নিজের অনড় অবস্থানের কথা ফের জানিয়ে দিয়েছে কমিশন।
কমিশনের চিঠির ব্যাপারে কোনও সরকারি প্রতিক্রিয়া রাত পর্যন্ত মেলেনি। তবে সরকারও যে তার সিদ্ধান্তে অনড়, সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “সরকারি স্তরে আলোচনা করেই যা বলার বলব। নতুন অবস্থান না-জানানো পর্যন্ত আমরা পুরনো অবস্থানেই অনড় থাকছি।” মহাকরণ সূত্রের খবর, কমিশনের দাবির মুখে এক দিনের জায়গায় দু’দিন ভোট এবং ভোটের জেলাওয়াড়ি বিন্যাস বদল করার পরে আর বিন্দুমাত্র নরম হতে রাজি নয় রাজ্য সরকার। শাসক দলের মতে, সেটা করা হলে তাদের রাজনৈতিক ক্ষতি হবে। বার্তা যাবে, সরকারের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই কারণে, কমিশন যদি শেষ পর্যন্ত সরকারের ঘোষণা মেনে ভোট করাতে রাজি না-হয়, তা হলে পঞ্চায়েতের মেয়াদ ফুরনোর পরে প্রশাসক নিয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে।
মঙ্গলবার দিনভর টানাপোড়েন এবং রাজ্যপালের হস্তক্ষেপের পরে রাজ্য সরকার কমিশনকে চিঠি এবং বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের জেলাওয়াড়ি বিন্যাস কিছুটা বদল করেছিল। গোড়ায় ৩০ এপ্রিল উত্তরবঙ্গের তিন জেলার ভোট হবে বলা হলেও সে দিন জানানো হয়, উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলা এবং মুর্শিদাবাদে ভোট হবে ওই দিনে। কিন্তু কমিশনের মূল দুই দাবি, তিন দফায় ভোট এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে চিঠিতে কিছু বলা হয়নি।
কমিশন এ দিন তার চিঠিতে তিন দিনে ভোটের প্রসঙ্গ না-তুললেও সরকার যে ভাবে দু’দফা ভোটের প্রস্তাব করেছে তা নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা চেয়েছে। কিছু মতামতও দিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ছ’টির পরিবর্তে আরও কয়েকটি জেলা অন্তর্ভুক্ত করতে চায় তারা। যাতে দু’দফায় সমান সংখ্যক বুথে ভোট গ্রহণ করা যায়। প্রতি বুথে দু’জন করে সশস্ত্র আধা সেনা রেখে ভোট করানোর ব্যাপারেও কমিশন অনড়। সে জন্য ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার কথা বলা হয়েছে এ দিনের চিঠিতেও।
আধা সেনার ব্যাপারে কমিশনের দাবি এ দিনও উড়িয়ে দিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “কমিশন যে সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনী চাইছে তা অবাস্তব। কোথা থেকে ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাব? টাকাই বা কে দেবে?” রাজ্য কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর বিপক্ষে? পঞ্চায়েত দফতরের এক কর্তার কথায়, “আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, এটা সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। দু’একটা স্কুল-কলেজের ভোটে বা পাড়ায় গোলমাল হয়েছে বলেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ল? রাজ্য পুলিশ দিয়েই অবাধে ভোট করানো সম্ভব বলে আমাদের মত।”
সরকার যে দু’দিন ভোট করার কথা বলেছে, সেই দু’দিনে ভোট করানো সম্ভব নয় বলেও এ দিন তাদের চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে কমিশন। কমিশনের সচিব তাপস রায়ের ব্যাখ্যা, বিজ্ঞপ্তি জারির দিন থেকে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত ৪২ দিন সময় লাগে। আর সাধারণত ছুটির দিনে কমিশন নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি জারি করে না। ফলে খুব তাড়াতাড়ি করলেও বিজ্ঞপ্তি জারি করা যাবে সোমবার। তাতে ২৬ বা ৩০ তারিখ ভোট করা সম্ভব নয়।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের অবশ্য দাবি, “আমি যত দূর জানি, বিজ্ঞপ্তি জারির ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে ভোট করা যাবে। ফলে হাতে এখনও সময় রয়েছে।” কিন্তু সিপিএম নেতা রবীন দেবের মতে, “মনোনয়ন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার দিন থেকে ভোটগ্রহণের দিন পর্যন্ত ২১ থেকে ৩৫ দিনের ব্যবধান রাখতে হয়।” আর কমিশন সূত্রে বলা হচ্ছে, বিজ্ঞপ্তি জারির পরে মনোনয়ন পেশের জন্য সময় দিতে হয় সাত দিন। ইভিএম ব্যবহার করা হলে মনোনয়ন পেশের ২১ দিন পরে ভোট করা সম্ভব। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট হবে ব্যালট পেপারে। ফলে ব্যালট ছাপার জন্য সময় দিতে হবে। তাই ৩৫ দিনই সময় লাগবে। সব মিলিয়ে ৪২ দিন।
কমিশন যেমন তার চিঠিতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কোনও রকম আলোচনা না-করেই ভোটের দিন ঘোষণার অভিযোগ এনেছে, তেমনই কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছে সরকার ও শাসক দল। সুব্রতবাবু এবং মুকুলবাবুর বক্তব্য, পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারায় রাজ্য ভোটের দিন ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। সেই অনুযায়ী ৪৩(১) ধারা মেনে কমিশনের আগে ভোটের পরবর্তী ধাপগুলি (মনোনয়ন পেশ ও প্রত্যাহারের দিন ইত্যাদি) বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো উচিত। তা না-করে তারা ৪৩(২) ধারায় রাজ্য সরকারকে পাল্টা চিঠি দিয়েছে। যা বেআইনি। যদিও অনেক পঞ্চায়েত-কর্তা ও আইন বিশেষজ্ঞের মতে, কমিশন ঠিক পথেই এগিয়েছে। রাজ্যের প্রস্তাব পছন্দ হলে তারা বিজ্ঞপ্তি দিত। পছন্দ হয়নি বলেই পাল্টা চিঠি দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। আইনে সে কথাই লেখা আছে।
সরকার-কমিশন সংঘাতে কি রাজ্যে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে চলেছে? সময়ে পঞ্চায়েত ভোট না-হলে কী হবে, তা নিয়ে আইনজীবী মহল দ্বিধাবিভক্ত। একটি সরকারের সূত্র প্রশাসক বসিয়ে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম স্বাভাবিক রাখা যাবে বলেই আশাবাদী। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রের টাকা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে পঞ্চায়েত-কর্তাদের একাংশের মনে সংশয় রয়েছে। অন্য একটি অংশ বলছেন, কেন্দ্র টাকা দেয় কাজের অগ্রগতি এবং কাজ শেষের শংসাপত্র দেখে। তার সঙ্গে নির্বাচিত পঞ্চায়েত থাকা বা না-থাকার সম্পর্ক নেই।
কিন্তু রাজ্যপাল যদি প্রশাসক নিয়োগে রাজি না হন? মহাকরণ সূত্রের দাবি, সরকার অনড় থাকলে রাজ্যপালের কিছু করার নেই। তিনি বড়জোর এক বার সরকারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেন। এম কে নারায়ণন এখনও সরকার-কমিশন সংঘাত এড়ানোর চেষ্টায় সক্রিয়। এ দিন দু’বার রাজভবনে যান রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। আজ শুক্রবার যাওয়ার কথা পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়ের।
এ দিনই পঞ্চায়েত ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার জন্য হস্তক্ষেপের আর্জি জানিয়ে রাজ্যপালকে চিঠি দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। আর সিপিএম সাধারণ সম্পাদক বিমান বসুর মন্তব্য, “আমাদের আমলে ৭টি পঞ্চায়েত ভোট হলেও এমন পরিস্থিতি হয়নি। একটা নির্বাচন পরিচালনা করতেই এরা গলদঘর্ম হচ্ছে।”

কমিশনের জবাব রাজ্যের মনোভাব
আলোচনা না-করেই ফের দিন ঘোষণা করেছে রাজ্য
সরকারের ঘোষিত দিনে ভোট করা সম্ভব নয়
প্রতিটি বুথেই লাগবে দু’জন করে আধাসেনা
সেই জন্য ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাই
মনোনয়নের পেশের দিন থেকেই চাই ৪০০ কোম্পানি
কমিশনের দাবি কোনও অবস্থাতেই মানা হবে না
আধাসেনা দরকার নেই, ফের বললেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী
রাজ্য নিজের অধিকার প্রয়োগ করেছে, দাবি মুকুল রায়ের
কমিশন অনড় থাকলে প্রশাসক বসানোর ভাবনা
প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স জারি করে প্রশাসক নিয়োগ

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.