চুরানব্বইয়ের পরে একানব্বই।
কাঁটাতারের ওপারের জমিতে চাষ করতে যাওয়ার আগে এখন আর তেমন কোনও চিন্তায় পড়েন না জেলমহম্মদ মণ্ডল। সকালে যাওয়ার সময়ে সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে হাসিঠাট্টাও হয় আজকাল। আর তখনই মনে পড়ে কয়েক মাস আগেই এই সীমান্ত পেরিয়ে কাঁটাতারের ওপারের জমিতে চাষ করতে যাওয়ার সময়ে কতটা উদ্বেগ হত। সীমান্তরক্ষীদের প্রশ্নবানের ভয়েই কাঁটা হয়ে থাকতে হত। তেহট্টের সীমান্তের মানুষ জানাচ্ছেন, বিএসএফের সেই রুক্ষ্ম মেজাজ কমেছে। বরং তাঁরা এখন গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে আগ্রহী। ডুমুরগাছের ছায়ায় কাঁধ থেকে জোয়ালটা নামিয়ে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে মধুগাড়ির জেলমহম্মদ মণ্ডল বলেন, “এখন সীমান্তে বিএসএফের একানব্বই ব্যাটেলিয়ন রয়েছে। তারা কাউকে অহেতুক হয়রান করছে না। এরা যতদিন আছে ততদিন কোনও উটকো ঝামেলাও নেই।”
সংখ্যা-সখ্য
গ্রামের মানুষ বিএসএফ-কে এই সংখ্যা দিয়েই বোঝেন। কখন কোন ব্যাটেলিয়ন আসছে, তার উপরে নজর রাখেন তাঁরা। তাঁদের কথায় কোনও ব্যাটেলিয়ন ভাল, কোনও ব্যাটেলিয়ন খারাপ। সেটা তারা ব্যাটেলিয়নগুলির অঙ্কের ওই নাম দিয়েই বোঝেন। করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ শঙ্কর মণ্ডল বলেন, “৯৪ ও ৯১ এগুলো আসলে বিএসএফের ব্যাটেলিয়ন। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর থেকে আসা ৯৪ ব্যাটেলিয়ন খুব ভাল কাজ করেছিল। তারপর অনেক বছর পর ত্রিপুরা থেকে এখানে এসে এখন ৯১ ব্যাটেলিয়নও মানুষের মন জয় করে নিয়েছে।” শঙ্করবাবু বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যে ব্যাটেলিয়ন সীমান্তের সাধারণ মানুষের মন জয় করতে পেরেছে, সীমান্তে তারাই সফল হয়েছে। সীমান্ত ও বিএসএফ উভয়ের জন্যই এটা অত্যন্ত জরুরি।”
সম্পর্কের সমীকরণ
সীমান্তরক্ষীদের কাজটা যে আর পাঁচটা সাধারণ কাজের মতো নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। বেশিরভাগ জওয়ানেরই দীর্ঘ চাকরি জীবনটাই কাটে বাড়ির বাইরে। সারা বছরে ছুটি মেলে হাতে গোনা দুই একবার। ফলে বাড়ির বাইরে থাকতে থাকতে জওয়ানদের মধ্যে দুই ধরনের মানসিকতা দেখা যায়। বিএসএফের এক কর্তা যেমন বলছিলেন, “কিছু জওয়ান যেমন বাড়ির বাইরে থাকতে থাকতে অনেক সময় খিটখিটে হয়ে যান, তাঁর ব্যবহারও রুক্ষ্ম হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ যেখানে ডিউটি করেন, সেখানকার মানুষের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করেন, সকলকেই আপন করে নেন। দু’টো ক্ষেত্রেই কারণটা এক। কিন্তু ফলটা দু’রকম। নিজেদের মধ্যে কাউন্সেলিং করে এই সমস্যাগুলো মেটানো হয়।” ওই কর্তার কথায়, “তবে এখন বিএসএফের ছুটি পাওয়ার ক্ষেত্রে আগের থেকে সুযোগ অনেক বেড়েছে। মোবাইলেও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন জওয়ানরা। এত কিছুর পরেও বাড়ি থেকে দূরে থাকার একটা কষ্ট তো রয়েছেই। তবে যে কোন ব্যাটেলিয়নের সম্বন্ধেই গ্রামবাসীদের প্রত্যাশা কী, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
সীমান্তের নাড়িনক্ষত্র
সীমান্তরক্ষীদের কাজটাও সহজ নয়। কোথায় কাশ্মীর আর কোথায় কাছারিপাড়া! যে কোনও নতুন ব্যাটেলিয়নের কাছে এটাও একটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কংগ্রেসের সুরপতি প্রামাণিক বলেন, “২০০১-০২ সাল নাগাদ এই সীমান্তও যথেষ্ট অশান্ত ছিল। একদিকে চোরাপাচারকারীদের রমরমা, বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের তান্ডবে রাতের ঘুম ছুটে যাচ্ছিল প্রান্তবাসীদের।” অন্য দিকে, বিএসএফ সাধারণ মানুষকে বিনা কারণে হয়রানি করছে বলে প্রায়ই অভিযোগ উঠত। ফলে বিএসএফের উপর থেকে ক্রমশ আস্থা হারাচ্ছিলেন সীমান্তের মানুষ। সুরপতিবাবু বলেন, “ঠিক এই রকম একটা টালমাটাল অবস্থায় ২০০৩ সাল নাগাদ সীমান্তে এল ৯৪ ব্যাটেলিয়ন। কয়েক দিনের মধ্যেই চোরাপাচারকারীদের ত্রাস হয়ে উঠল ওই ব্যাটেলিয়ন।” তারকাঁটার ওপারের মাঠে বাংলাদেশী দুষ্কৃতীরা যাতে তান্ডব চালাতে না পারে, সেই জন্য নাসিরেরপাড়া সীমান্তে চরের মাঠে তৈরি হল বিএসএফের মাঠ ক্যাম্প। এরপরেই গ্রামের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ছোট ছোট বৈঠক, অনুষ্ঠান করে মানুষের মন জয় করে ফেলল ওই ব্যাটেলিয়ন।”
২০০৭ সালে সেই ব্যাটেলিয়ন চলে যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পর সীমান্তে আসে ৯১ ব্যাটেলিয়ন। করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ কংগ্রেসের ইসমাইল বিশ্বাস বলছেন, “৯৪ নম্বর ব্যাটেলিয়ন যদি অশান্ত সীমান্তকে শান্ত করে থাকে তাহলে ৯১ ব্যাটেলিয়নের সৌজন্যে কিন্তু এই প্রথম পদ্মার ওপারে চরের জমিতে নিশ্চিন্তে চাষআবাদ করছেন মধুগাড়ি, কাছারিপাড়া, বাউসমারি সীমান্তের চাষিরা। এই প্রথম ওই চরের জমিতে খোলা আকাশের নীচে রীতিমত মাচা বেঁধে দিনরাত ফসল পাহারা দিচ্ছেন এই ব্যাটেলিয়নের জওয়ানেরা। এই ব্যাটেলিয়নকে আমরা সারাজীবন মনে রাখব।” ৯১ , ৯৪ তো বটেই তারকাঁটার ওপারের জনপদ চরমেঘনা মনে রাখবে ১৩৮ ব্যাটেলিয়নকেও। সেই ব্যাটেলিয়নের সৌজন্যেই ২০০০ সালে চরমেঘনায় তৈরি হয়েছিল স্বাধীন একটি ক্যাম্প। যেটা চরমেঘনার কাছে আজও সবচেয়ে বড় ভরসা।
এবং ৯১
চরমেঘনা গ্রামের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী লিপিকা সর্দার, সঞ্চিতা সর্দার, অনামিকা মণ্ডলরা এতদিন পায়ে হেঁটে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে দীর্ঘ পথ উজিয়ে স্কুলে যেত। এ বার থেকে ওরা সাইকেলে স্কুলে যাবে। চরমেঘনার কণিকা মণ্ডল, বন্দনা মণ্ডলরাও সেলাই শিখে বাড়িতে সেলাই মেশিন নিয়ে এসে স্বনির্ভর হয়েছেন। চরমেঘনা, মেঘনা ও সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে এখন দাপিয়ে চলছে ক্যারম, ফুটবল, ভলি ও ক্রিকেট। প্রাথমিক স্কুলের ছেলেমেয়েরা মলাট দেওয়া নতুন খাতায় আঁকছে রঙবেরঙের ছবি। স্কুলগুলোও সেজে উঠেছে নতুন রঙে। বসেছে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপও। এসবই সম্ভব হয়েছে ৯১ ব্যাটেলিয়নের সৌজন্যে। দিনকয়েক আগে মেঘনা বিএসএফ ক্যাম্পে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মেডিক্যাল ক্যাম্পের পাশাপাশি সেলাইমেশিন, সাইকেল ও অন্য জিনিসপত্র বিতরণ করেছে ৯১ ব্যটেলিয়নের কম্যান্ডান্ট কে ডি যাদব ও ডিআইজি (রোশনবাগ) আর সি ধ্যানী সহ বিএসএফের অন্যান্য কর্তারা। মেঘনা প্রাথমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক নীতীশ বিশ্বাস বলছেন, “এই ব্যাটেলিয়নের জন্য আমাদের স্কুলের সামগ্রিক চেহারাটাই পাল্টে গিয়েছে। বলেছে পাখা ও চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থাও করে দেবেন তাঁরা।” শুধু দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক নয়, সীমান্ত এলাকার যাবতীয় সুখ দুঃখের সমান অংশীদার হচ্ছে এই ব্যাটেলিয়ন। এটা আমাদের কাছে বিরাট প্রাপ্তি।”
জনসংযোগ
বিএসএফের এই সমস্ত কাজকর্মের ফলে যেটা বাড়ছে সেটা হচ্ছে জনসংযোগ। সীমান্তে সফলভাবে কাজ করতে গেলে যেটা বিএসএফের জন্য ভীষণ জরুরি। চরমেঘনার বাসিন্দা তথা করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ উত্তম সর্দার বলছেন, “এই ব্যাটেলিয়ন আসার পরে পাচার প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও সুসম্পর্কের কারণে সীমান্তের মানুষও এই ব্যাটেলিয়নকে ভরসা করছেন। এতে কোনও তরফেই কোনও সমস্যা থাকছে না।” করিমপুরের বিধায়ক সিপিএমের সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “সীমান্তের লোকজন যেমন টিভি ও সিনেমার কল্যাণে কাজ চালানোর মতো হিন্দি বলতে পারেন, তেমনই বিএসএফও এখন বাংলা বলতে পারে। ফলে সেই ভাষা সমস্যাটা এখন আর নেই। আর স্থানীয় মানুষের সঙ্গে এই ব্যাটেলিয়ন যে ভাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে সেটা সবদিক থেকেই খুব ভাল।” তেহট্টের মহকুমাশাসক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, “সীমান্তের মানুষের সঙ্গে বিএসএফের এমন সম্পর্কটাই তো সবসময় কাম্য। এতে যেমন সুরক্ষিত থাকে সীমান্ত, তেমনই তার সুফলটাও পায় বিএসএফ ও গ্রামবাসী উভয়েই।” |