গত বারের মতো এই গ্রীষ্মেও লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি হবে না। অন্তত রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার তেমনই আশ্বাস। গত বারের মতো এ বছরেও সংস্থার দাবি, বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও তার জোগান দিতে পরিকাঠামো তৈরি রয়েছে। যা শুনে গত বারের মতো এ বারেও উঠে আসছে সেই পুরনো প্রশ্ন লোডশেডিং না-হওয়ার কৃতিত্ব কি শুধু বণ্টন সংস্থার? নতুন শিল্প সে ভাবে না-আসাটাও কি দায়ী নয়?
রাজ্য প্রশাসনেরই একাংশের মতে, মূলত নতুন বসতবাড়ি ছাড়া রাজ্যে নতুন শিল্পের জন্য বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদা বিশেষ নেই। বিদ্যুৎ ব্যবহারের বহর উল্লেখযোগ্য রকম বাড়িয়ে দেওয়ার মতো নতুন কোনও বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। কাজেই ঘাটতির সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ বিদ্যুতের ‘অপর্যাপ্ত’ জোগানের পিছনে রাজ্যে শিল্পায়নে খামতিরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলে এই মহলের অভিমত। যদিও বণ্টন-কর্তাদের দাবি, শিল্প-চাহিদা বাড়লেও তা মেটানোর মতো ক্ষমতা তাঁদের রয়েছে।
গত বছর মার্চ-এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গে বণ্টন-এলাকায় বিদ্যুতের সর্বাধিক চাহিদা উঠেছিল দৈনিক প্রায় ৪৮০০ মেগাওয়াট। এর সঙ্গে সিইএসসি-র চাহিদা মেটাতে বণ্টন সংস্থাকে সরবরাহ করতে হয়েছিল বাড়তি ৬০০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে গত গ্রীষ্মে চাহিদা উঠেছিল ৫৪০০ মেগাওয়াটে, এ বার যা ৫৮০০ মেগাওয়াটে দাঁড়াতে পারে বলে বণ্টন-কর্তাদের অনুমান। এবং তাঁদের আশ্বাস: ইউনিটগুলো পুরোদমে উৎপাদন চালানোয় গত গ্রীষ্মে যেমন সহজে বাড়তি চাহিদা সামাল দেওয়া গিয়েছিল, এ বারেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
এ দিকে সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। সঙ্গে বোরো চাষের মরসুম। এই দুই কারণে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত না-হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিদ্যুৎ-কর্তাদের তরফেও মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, উৎপাদন কেন্দ্রে বড় ধরনের যান্ত্রিক বিভ্রাট দেখা না-দিলে গরমে লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা বিশেষ নেই।
তবে বিদুৎক্ষেত্রের এ হেন আপাত স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিতে শিল্পক্ষেত্রের খরা-চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে করছেন সরকারের একাংশ। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “গরমে লোডশেডিং না-হওয়ার কৃতিত্ব শুধু বণ্টন সংস্থার নয়। রাজ্যে নতুন শিল্পের জন্য বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদা না-থাকায় গ্রীষ্মের ক’টা মাস সহজে পার হয়ে যাচ্ছে। গত দু’বছর ধরে রাজ্যে এটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।” বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা: শিল্প-চাহিদা না-বাড়লেও গোটা রাজ্যে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এমনকী, বিভিন্ন জেলা শহরেও এয়ার কন্ডিশনার-সহ বিবিধ বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের প্রবণতা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। “গত জুনে এক দিন সিইএসসি-অঞ্চলে চাহিদা উঠেছিল ১৯০০ মেগাওয়াট। কলকাতায় এসি মেশিন বিক্রি হয় ৪০ হাজার!” উদাহরণ দিচ্ছেন তিনি। গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন প্রকল্পের সুবাদে গৃহস্থ গ্রাহকের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে সাধারণ গ্রাহকের চাহিদা সামলিয়েও এই গ্রীষ্মে ৩০০-৪০০ মেগাওয়াট উদ্বৃত্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন ওই কর্তা। তিনি বলছেন, “নিজস্ব উৎপাদন ছাড়াও এনটিপিসি, এনএইচপিসি’র মতো বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আমাদের বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি রয়েছে। পাশাপাশি গত শীতে রাজ্যের যে বাড়তি বিদ্যুৎ অন্য রাজ্যকে দেওয়া হয়েছে (অর্থাৎ বিদ্যুৎ ব্যাঙ্কিং), এই গ্রীষ্মে তা ফেরত পাওয়া যাবে।” কর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার অনুমতি দেওয়ায় মাসুল যেমন বাড়ছে, তেমন গ্রাহকদের থেকে বাড়তি জ্বালানি খরচও আদায় হচ্ছে। ফলে বণ্টন সংস্থা ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম দুয়েরই আর্থিক অবস্থা অনেকটা ভাল। গ্রীষ্মের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ বা কয়লা কেনার টাকারও সমস্যা হবে না বলে তাঁরা আশাবাদী।
চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি উৎপাদনের ক্ষমতা তাঁদের রয়েছে বলে দাবি বিদ্যুৎকর্তাদের। কিন্তু তা যাচাইয়ের মতো বড় শিল্প গড়ে উঠছে কোথায়?
সেই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশাসনের অন্দরে। |