|
|
|
|
বেঙ্গালুরুতে ছাত্রের মৃত্যু |
র্যাগিংয়ের শিকার, প্রণব-মমতার দ্বারস্থ অসহায় বাবা |
প্রসূন আচার্য • কলকাতা |
তখন রাত ৯-টা ১৫ মিনিট। মা শোভা নস্করের সঙ্গে মোবাইলে কথা হচ্ছিল শোভনেশের। নরেন্দ্রপুরের ছেলে শোভনেশ বেঙ্গালুরুর একটি নামী কলেজে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গিয়েছিল। প্রতিদিনের মতোই শোভাদেবী ছেলেকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘সারা দিন তুই কোথায় ছিলি? পড়া করেছিস? খেয়েছিস?’ হঠাৎই শোভনেশ ওর এক বন্ধুর নাম ধরে চিৎকার করে বলে উঠল, কী করছিস? তার পরে সোঁ সোঁ শব্দ। মোবাইল বন্ধ।
কিছু ক্ষণ বাদে শোভনেশের বাবা গণেশবাবুকে ওর হস্টেলের এক রুম-মেট ফোন করে জানায়, ‘কাকু শোভনেশ খুব মদ খেয়েছে। ওর শরীর খারাপ। ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। চিন্তা করবেন না।’ একটু বাদেই বেঙ্গালুরু থেকে আর এক বন্ধুর ফোন। ‘কাকু, অটো চড়ার সময় শোভনেশের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ও হাসপাতালে আছে। আপনারা কালই চলে আসুন।’ ঠিক কী হয়েছে জানতে গণেশবাবু ফোন করেন শোভনেশের আর এক বন্ধুকে। সে বলে, ‘শোভনেশ হস্টেলের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে। হাসপাতালে আছে। কালই চলে আসুন।’ যাদের সঙ্গে গণেশবাবুর কথা হয়, তারা সকলেই কলকাতার ছেলে। কারও বাড়ি হরিনাভি। কারও সোনারপুর। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শোভনেশের হস্টেলের রুম-মেট ছিল তারা।
রাত পোহাতে ভোরের বিমানে কয়েক জন আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে গণেশবাবু বেঙ্গালুরু পৌঁছন। গিয়েই জানতে পারেন, আগের দিন রাতেই দুর্ঘটনায় তাঁর পুত্রের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহ পড়ে আছে কেআইএমএস হাসপাতালের মর্গে। মা’র সঙ্গে কথা বলতে বলতে কী ভাবে শোভনেশ মারা গেল? কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং শোভনেশের বন্ধুদের
বক্তব্য, মত্ত অবস্থায় সে কলেজের ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু ঘটনাস্থল দেখে এবং আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে গণেশবাবুর সন্দেহ দৃঢ় হয় যে, শোভনেশ আত্মহত্যা করেনি। র্যাগিং-এর নামে তাঁর
শোভনেশ নস্কর |
ছেলেকে চ্যাংদোলা করে উপর থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। মাথায় আঘাত লেগে তার মৃত্যু হয়।
ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্টে দেখা যায়, শোভনেশ আদৌ মদ খায়নি। বরং ওর পেটে ছিল আধা হজম হওয়া ভাত। গণেশবাবু আরও জানতে পারেন, মৃত অবস্থাতেই শোভনেশকে রাজশেখর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে ভর্তি না করে কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নিয়ে যাওয়া হয় কেআইএমএস হাসপাতালে। এর পরই আত্মহত্যার বদলে হত্যার অভিযোগে মামলা করতে গণেশবাবু পুলিশের দ্বারস্থ হন। কিন্তু জে পি নগর থানায় তাঁর অভিযোগ নেওয়া হয়নি।
শোভনেশের মৃত্যু হয়েছিল গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি। তার পর থেকেই শুরু হয়েছে গণেশবাবুর লড়াই। বিচার চেয়ে প্রায় এক বছর ধরে গণেশবাবু রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকলের কাছেই চিঠি দিয়েছেন। দরবার করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীর থেকে শুধু করে কর্নাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছেও। মুখ্যসচিব থেকে পুলিশের ডিজি সকলের দ্বারস্থ হয়েছেন। সামগ্রিক চাপে নামকাওয়াস্তে সিআইডি তদন্ত শুরু হলেও মেলেনি বিচার।
ঘটনার এক মাস পরে গত মার্চে গণেশবাবু একটি সূত্রে পুরো ঘটনা তৎকালীন ডিজি-সিআইডি ভি ভি থাম্বিকে জানান। থাম্বি চিঠি লেখেন কর্নাাটকের ডিজি-সিআইডি শঙ্কর বদ্রীকে। বিচার চেয়ে কলকাতা-বেঙ্গালুরু করতে করতে গণেশবাবু তখন ক্লান্ত। বিধ্বস্ত। স্ত্রী মানসিক ভাবে অসুস্থ। সহানুভূতি দেখিয়ে শঙ্কর বদ্রী গণেশবাবুকে পাঠান বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার টি সুনীল কুমারের কাছে। তাঁর নির্দেশে অবশেষে পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
প্রথম থেকেই গণেশবাবুর সন্দেহ, শোভনেশের এক রুমমেটকে। পুলিশ কর্তাদের কাছে অভিযোগপত্রেও তিনি সে কথা বলেছেন। বেঙ্গালুরুতেই শোভনেশের একটি দামি মোবাইল খোয়া গিয়েছিল। মৃত্যুর কিছু দিন পরে তা উদ্ধার হয় হাওড়া থেকে। গণেশবাবুর অভিযোগ, “এই সূত্র ধরে তদন্ত করলেও কিছুটা কাজ হত। কিন্তু সিআইডি-র দুই অফিসার কলকাতায় ঘুরে যাওয়া ছাড়া কার্যত কিছুই করেননি। কারণ থানা এ ব্যাপারে তদন্ত এগোতে চায় না।” গণেশবাবুর আরও অভিযোগ, “শোভনেশ যে কলেজে পড়ত, সেই অক্সফোর্ড কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কোনও ভাবেই তদন্ত এগোতে দিতে চায় না। কারণ, তাহলে প্রমাণ হবে, র্যাগিং-এর ফলেই শোভনেশের মৃত্যু হয়েছে। এতে কলেজের বদনাম হবে।”
এ ব্যাপারে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, “বিষয়টি নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। পুলিশই সত্য-মিথ্যা বিচার করবে।” জে পি নগর থানার ওসি ভি এস অঙ্গডি বলেন, “আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে।” কিন্তু সিআইডি তদন্তের আগেই কী করে আত্মহত্যা বলা হচ্ছে? জবাবে আঙ্গডি বলেন, “তদন্ত হচ্ছে। দেখা যাক, কী হয়।” |
|
|
|
|
|