|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: ফ্রি সিনেমা |
শিশির রায় |
ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৫৬। লন্ডনের ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটারে তিল ধারণের স্থান নেই, চারশো লোক বসতে না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন। ব্যাপার কী? খানকয়েক ছবি দেখানো হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাও ডকুমেন্টারি, তথ্যচিত্র। তার জন্য এত? কানাকানি, গুঞ্জন এ ছবিগুলো নাকি এক্কেবারে ‘অন্য রকম’, পরিচালকেরাও তাই। অচিরেই হাতে এল কয়েক পাতার অনুষ্ঠান-সূচি, তাতে তিনটে ছবির নাম, বিষয়বস্তু, নির্দেশক-পরিচিতি লেখা। সব ছাপিয়ে দুয়ের পাতায় জ্বলজ্বলে কয়েকটা লাইন। হামলে পড়ল সবাই।
‘এই ছবিগুলো এক সঙ্গে তৈরি হয়নি, এক সঙ্গে দেখানোর ভাবনাতেও তৈরি হয়নি। কিন্তু একত্র হওয়ার পর আমরা দেখলাম, ছবিগুলোর মধ্যে একটা দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে নিহিত আছে স্বাধীনতায় বিশ্বাস, মানুষের ওপর আস্থা, আর দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্ব।
‘পরিচালক হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি: কোনও ছবিই নিতান্ত ব্যক্তিগত হতে পারে না। ছবিতে কথা বলে দৃশ্য, ‘ইমেজ’, শব্দ শুধু কাজ করে বিষয়ের পরিবর্ধনে আর ভাষ্যদানে। (ফ্রেমের) আকার কী হবে তা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। পূর্ণতাও আমাদের লক্ষ্য নয়। দৃষ্টিভঙ্গি আর আঙ্গিক একই কথা। কী ভাবে দেখছি তা-ই ঠিক করে দেয় আঙ্গিক কী হবে, আবার আঙ্গিকটাই তৈরি করে দেয় দেখার চোখ।’
এতটুকুই, এই কয়েকটা লাইনই ছিল ‘ম্যানিফেস্টো অব ফ্রি সিনেমা’। তলায় চার জনের সই লোরেঞ্জা ম্যাজেত্তি, লিন্ডসে অ্যান্ডারসন, কারেল রিজ, টোনি রিচার্ডসন। চার জন মানুষ, কিন্তু ওই যে, ম্যানিফেস্টোর শুরুতেই বলা, এক ভাবনা, দেখার চোখ এক! সবাই মিলেছিলেন লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের ডাকে। তাই ‘ফ্রি সিনেমা’ আন্দোলনের তিনিই প্রাণপুরুষ, বলা যেতেই পারে। অক্সফোর্ডের কলেজে পড়তে পড়তেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনার চাকরি, ফিরে এসে শুরু করেন সমালোচনামূলক ফিল্ম ম্যাগাজিন ‘সিক্যুয়েন্স’। ফ্রান্সে যেমন ফিল্মের নবতরঙ্গের দামামা বেজে উঠেছিল আন্দ্রে বাজাঁ-র ‘কাইয়ে দু সিনেমা’ পত্রিকা ঘিরে, খাস লন্ডনে কয়েকটা মোটে সংখ্যা বের হওয়া ‘সিক্যুয়েন্স’ পত্রিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ‘ফ্রি সিনেমা মুভমেন্ট’-এর কারিগরদের সেতুবন্ধনে। এই পত্রিকাতেই অ্যান্ডারসন লেখেন, সেগুলোই ‘ফ্রি সিনেমা’, যা কখনও আপস করে না দেশ-সমাজ-রাজনীতি-পরিপার্শ্বের সঙ্গে, আর্থিক লাভক্ষতির আঁক না কষে সটান সপাট চিত্রভাষায় বলে দেয়: মনের মধ্যে টলটল বা টনটন করছে যা কিছু। |
|
লোরেঞ্জা ম্যাজেত্তি-র ‘টুগেদার’ ছবির দৃশ্য |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে বেশ ক’বছর, কিন্তু গোটা ইউরোপ জুড়ে তার ঘা তখনও দগদগে। ইংল্যান্ডের অর্থনীতির পালে হাওয়া নেই একেবারে, লেবার পার্টির সরকার মুখ থুবড়ে পড়েছে ১৯৪৫-এই। সারা দেশে শুধু নাত্সি জার্মানির তাড়া খাওয়া ভিনদেশি শরণার্থী, আর অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ ফেরত শিক্ষিত, বিভ্রান্ত বেকারের ছড়াছড়ি। ঘরে বাইরে এ হেন পরিস্থিতি সচরাচর জন্ম দেয় রাগী, প্রতিবাদী শিল্পকৃতির, স্বতন্ত্র স্বরের। অথচ তখনকার ব্রিটিশ সিনেমা, এমনকী তথ্যচিত্রও সেই কৃত্রিম, জবরজং সেট-এর ব্যবহারে, স্টুডিয়োভিত্তিক প্রযোজনার কড়ারেই স্বেচ্ছাবদ্ধ ছিল। অ্যান্ডারসনরা চেয়েছিলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে, সম্পূর্ণ ভিন্ন, সহজসাধ্য আঙ্গিকে ছবি বানাতে। হোক তা ১৬ মিলিমিটার রিলের ক্যামেরায়, আলাদা সাউন্ডট্র্যাকে তোলা, সূত্রধরের ধারাভাষ্যহীন দৃশ্য-সিরিজ। ছবি নামল পথেঘাটে, পিচওঠা কাঁকরমুখো রাস্তায়, আর দেখাল মানুষের উপস্থিতি। সাধারণ, দিন-আনি-দিন-খাই মানুষ, ঘামগন্ধওলা খেটো মানুষ, মানুষের জীবন, যন্ত্রণা। মধ্য বিত্ত-মেধার চাপে পড়ে ১৯৩০-৪০ এর ব্রিটিশ ডকুমেন্টারি ছবিতে যে মানুষগুলো, বিষয়গুলো হারিয়ে গিয়েছিল, তারাই ফিরে এল ‘ফ্রি সিনেমা’র হাত ধরে।
অ্যান্ডারসনের তৈরি, সেই ফেব্রুয়ারি-সন্ধ্যার প্রথম ছবি ‘ও ড্রিমল্যান্ড’-এর বিষয় একটা মেলা। বারো মিনিটের এই ছবিতে হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরার রুক্ষ ঝাঁকুনিতে আর ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজে উঠে আসে মেলার বিস্তর মজা নয়, বরং অস্বস্তিকর, নোংরা অথচ রীতিমত বাস্তব দিকগুলো। কারেল রিজ আর টোনি রিচার্ডসন দু’জনে ন’টা শনিবারের সন্ধ্যা ধরে শু্যট করেন শহরতলির ‘উড গ্রিন জ্যাজ ক্লাব’-এর সদস্যদের নাচগান, লাফাঝাঁপা। নাক-উঁচু সমাজের চোখে বেয়াড়া, নিয়মভাঙা এক ঝাঁক ছেলেমেয়ের সুরসাধনাই হয়ে ওঠে ‘মামা ডোন্ট অ্যালাও’ ছবির উপজীব্য। আর ‘ফ্রি সিনেমা’ ম্যানিফেস্টোর পাতায় প্রথমেই যাঁর সই, সেই লোরেঞ্জা ম্যাজেত্তি-র ছবি ‘টুগেদার’ আদতে তথ্যচিত্র-ঢঙে তৈরি ৫২ মিনিটের একটা ফিকশন ফিল্ম, বোমায় বিধ্বস্ত লন্ডনের ইস্ট এন্ড পাড়ার এক জোড়া মূক-বধির ব্যক্তিকে নিয়ে, রোজ যাঁদের পেছনে লাগে মুখ-ভ্যাঙানো বাচ্চার পাল থেকে শুরু করে পাড়ার বড়রাও। বিষয়ের নির্বাচনে, আঙ্গিকের প্রয়োগে ফ্রি সিনেমা এ ভাবেই ‘প্রান্তিক অপর’কে আনতে চেয়েছিল শিল্পের, বোধের তথা মনোযোগের কেন্দ্রে।
ম্যানিফেস্টোয় সই না করলেও আরও দু’জন জড়িয়ে ছিলেন ‘ফ্রি সিনেমা’র সঙ্গে। ওয়াল্টার লাস্যালি এবং জন ফ্লেচার। পরিচালকদের ভাবনা ক্যামেরার চোখে ফুটিয়ে তুলতেন প্রধান আলোকচিত্রী লাস্যালি, আর ফ্লেচার মূলত ধ্বনি (মাঝে মধ্যে ইমেজ) নিয়ে কাজ করতেন। অ্যান্ডারসনের নেতৃত্বে ছোট্ট এই ছবি-করিয়ে দলটির দৃঢ় কমিটমেন্ট ছিল মানুষের প্রতি। এঁদের কাছে সিনেমা একটা শিল্প, আবার একই সঙ্গে একটা তীব্র সাংস্কৃতিক ও প্রচারধর্মী শক্তি। সিনেমাকে এঁরা তাই নিয়েছেন নান্দনিক ও রাজনৈতিক, দু’ভাবেই। খর সমালোচনা-দৃষ্টি মানেই এক অর্থে তা রাজনৈতিক, আর সে রাজনীতিটা বলতে হবে সোজাসাপটা, ঘুরিয়ে-বেঁকিয়ে নয়। ছবিতে নৈর্ব্যক্তিকতা তাই অনভিপ্রেত, চাই ফরাসি চিত্রনির্মাতা জাঁ ভিগো-র ‘সোশাল সিনেমা’, বা ইতালির ভিত্তোরিও ডি সিকা বা রবের্তো রোসেলিনি-র ‘নিয়ো-রিয়্যালিস্ট’ আঙ্গিকধর্মী তথ্যচিত্র। ইংরেজি তথ্যচিত্রের পথিকৃত্ জন গ্রিয়ারসন-এর দর্শনে ‘ফ্রি সিনেমা’র তত আস্থা ছিল না, ফরাসি নবতরঙ্গের ‘অতিয়র’ধর্মিতায়ও (ফিল্ম আসলে এক জন রচয়িতারই সৃষ্টি) না। বরং আর এক প্রবাদপ্রতিম ইংরেজ তথ্যচিত্র-নির্দেশক হামফ্রে জেনিংস-এর ‘মাস অবজার্ভেশন’ তত্ত্ব অনেক বেশি মনে ধরেছিল অ্যান্ডারসনদের। তবু, সমস্ত মতবাদ-বিসম্বাদের কচকচি পেরিয়েও জেগে থাকে শুধু ছবিগুলোই। কারেল রিজ বলেছিলেন: আমাদের এই মুভমেন্ট এমন আহামরি দামি কিছু নয়, দাম আমাদের তৈরি ছবিগুলোর।
তবু ধুন্ধুমার প্রচার পেয়েছিল ‘ফ্রি সিনেমা’। কাগজে বিস্তর লেখালিখি, হল উপচানো দর্শক, ছবি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ এই ক’বছরে ছ’খানা ‘প্রোগ্রাম’-এই ‘ফ্রি সিনেমা’র যাত্রা শুরু, ও শেষ। তিনটে প্রোগ্রাম জুড়ে ছিল শুধু বিদেশি ছবি। কানাডার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার নর্মান ম্যাকলারেন-এর ছবি, মার্কিন ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম’ ধারার নির্দেশক লিয়োনেল রোগোসিন-এর যুগান্তকারী ছবি ‘অন দ্য বাওয়ারি’ প্রদর্শিত হয় দ্বিতীয় প্রোগ্রামে। চতুর্থ প্রোগ্রামে পোল্যান্ডের নতুন ছবি, পঞ্চমটায় ফরাসি নবতরঙ্গের কিছু ছবি। ইংরেজি তথ্যচিত্রের দুনিয়ায় নবজাগরণের বান আসে ‘ফ্রি সিনেমা’কে কেন্দ্র করে। শেষ প্রোগ্রামের দর্শকরা হাতে পেলেন অ্যান্ডারসনের লেখা নতুন কয়েক লাইন: ‘উপযোগবাদ ও বাণিজ্যিকীকরণের চাপে ওষ্ঠাগত এক পৃথিবীতে এই ছবিগুলো বানিয়ে ও আপনাদের দেখিয়ে আমরা স্বাধীন, সৃষ্টিমূলক ছবির পক্ষে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস, আর তার বাস্তবায়নও, আশা রাখি, থেমে যাবে না কোনও দিন...।’ |
|
|
|
|
|