ভূত প্রতিপালন সমিতি
মাদের গ্রামে যখন কোনও ছেলে বা মেয়ে সবে হাঁটতে এবং কথা বলতে পারত, তখন বড়রা তাকে তিনটে কথা শিখিয়ে দিতেন। আমিও তিনটে কথা বলতে শিখেছিলাম। এক, আমার নাম শ্রীমান অভয়পদ দাস। দুই, আমার বাবার নাম শ্রীযুক্ত নিরাপদ দাস। আর, আমার গ্রামের নাম কাঞ্চনপুর, থানা মহিষাদল, জেলা মেদিনীপুর। যদি অচেনা কেউ জিজ্ঞেস করে অথবা কখনও গ্রামের মেলায় হারিয়ে যাই, তখন চটপট যেন বলে দিতে পারি, তাই ছোটদের এই তিনটি কথা শেখানো হত।
এই তিনটি কথা আমরা মুখস্থও করে ফেলতাম। যখন সন্ধে হব হব করত, পুকুরের জলে ডুব দেওয়ার মতো করে সূর্য টুপুস হত, আমরা কালীতলার মাঠ ছেড়ে তখন ছুট দিতাম বাড়ির দিকে। গোটা রাস্তাটা তখন ওই তিনটি কথা আবৃত্তি করতে করতে ফিরতাম। না, ওটা আরও ভাল করে মনে রাখার জন্যে আবৃত্তি করতাম না। ভূত, পেতনি, শাঁখচুন্নি, ব্রহ্মদত্যি, এমনকী রাক্ষসখোক্কসও যে তখন এসে ভিড় করত আমাদের বাড়ি ফেরার পথে। তাদের ভয় তাড়াতে আমরা ছোটরা এই সব মুখস্থ বলতাম।
বড়রা সত্যি সত্যি কেউ কখনও রাক্ষস দেখেছেন কি না, জানি না! তবে আমরা ছোটরা কয়েক জন রাক্ষস দেখেছি। ঠাকুমার মুখে শোনা রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প থেকে উঠে এসে সেই সব রাক্ষস এক-এক দিন আমাদের বাড়ি ফেরার পথে ভয় পাওয়ার কারণ হয়ে উঠত।
রোজ আমরা সকলে মিলে বিকেলে কালীতলার মাঠে খেলতে আসি। আমি এক দিন বিকেলবেলা কালীতলার মাঠে খেলতে এসে বন্ধুদের একটা গল্প বলতে শুরু করলাম, ‘আমার বাড়ি ফেরার রাস্তার ধারে একটা ঝাঁকড়া মহানিমের গাছ আছে না? কাল আমি যখন আমার নাম আর বাবার নাম মুখস্থ বলতে বলতে মহানিম গাছের নীচ দিয়ে অন্ধকারে দৌড়ে বাড়ি ফিরছিলাম, তখন কী দেখেছি জানিস?’
ছবি: সুমন চৌধুরী
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘কী দেখেছিস, আমরা বলে দিতে পারি।’
আমি বললাম, ‘বল তো কী?’
ওরা বলল, ‘কী আবার, ভূত, নয়তো পেতনি।’
বললাম, ‘না, না, আমি যা দেখছি, শুনলে তোরা ভয় পেয়ে যাবি। গাছটার নীচে ঝাঁকড়া চুল আর বড় বড় চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাবণের বোন শূর্পনখা রাক্ষসী।’
দেবদীপ হাঁ করে আমার রাক্ষসী দেখার গল্প শুনছিল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘তোর ভয় করেনি? কী করছিল তখন রাক্ষসীটা? তোকে বড় বড় নখ দিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল? আচ্ছা, তোকে দেখে রাক্ষসীটাই ভয় পেয়ে যায়নি তো?’
আমি বললাম, ‘আমি কি রাক্ষসীদের স্কুলের হেডদিদিমণি যে আমাকে দেখে ভয় পাবে? তুই এমন আজব কথা বলিস। না রে বাবা, না। রাক্ষসীটা সে সব কিছুই করেনি। সে নিজের মনে এ দিক ও দিক ছুটে ছুটে শুধু জোনাক পোকা ধরছিল।’
দেবদীপ আমার এই কথায় হো হো করে হেসে বলল, ‘ধুত, রাক্ষসী আবার বাবুই পাখি নাকি যে, জোনাক পোকা ধরে বাসায় আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা করবে? আজব কথা আর বলিস না তো! কবে আবার না বলে বসিস, পুতনা রাক্ষসী তোর মায়ের খুব বন্ধু! গেল বার বিজয়ার দিন এক হাঁড়ি চন্দ্রপুলি নিয়ে তোদের বাড়ি এসেছিল বিজয়া করতে। আর তুই ঢপ করে প্রণাম করতেই, রাক্ষসীটা তোকে প্রত্যেকটা অঙ্ক পরীক্ষায় একশো পাওয়ার বর দিয়েছিল।’
আমার রাক্ষসী দেখার কথা দেবদীপ কেন বিশ্বাস করছে না জানি না, তবে সব শুনে অভিরাম আমার গায়ের একদম কাছে সরে এসে বলল, ‘জানিস তো, আমি কাল কালীতলার মাঠ থেকে খেলার পরে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, হঠাত্‌ দেখি কী, আমাদের খালের বাঁশের সাঁকোয় হেলান দিয়ে মহাভারতের ভীমের আত্মীয় হিড়িম্ব রাক্ষস গোটা আকাশ ঢুঁড়ে কালপুরুষ খুঁজছে।’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই তখন কী করলি? সাঁকো পেরোলি? ফিরলি কোন রাস্তা দিয়ে?’
অভিরাম চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আর সাঁকো পেরোই? পিছন ফিরে সেই যে ছুট দিলাম, থামলাম একেবারে মাঝের পাড়ার অন্তুদের বাড়ির পাশের তিন মাথার মোড়ে।’
আরও কে কে যে রাক্ষস দেখেছে, ভয় পেয়ে কেউই এত দিন কিছুই বলেনি। আমি আর অভিরাম রাক্ষস দেখেছি বলতে, বিনয় নিজের চোখে রাক্ষস দেখার কথা সকলের সামনে কবুল করল।
বিনয়ের কথায় আমরা সকলেই হাঁ। কারণ, বিনয় আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভিতু, সকলেই জানি। সে এক বার ঘোর বর্ষার দিনে হেডস্যরের কাছে রেনি ডে’র ছুটি চাইতে গিয়ে কেঁদে একশা হয়েছিল, সে কথা আমরা এখনও কেউ ভুলিনি।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যি?’
বিনয়ের দু’চোখ ছলছল হয়ে উঠল। বলল, ‘আমি এত দিন তোদের কথাটা বলব বলব করেও বলিনি। সাত-আট দিন আগে এক দিন রাতে বারান্দায় বসে ভূগোল পড়ছিলাম। দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছিল। কারাকোরাম পর্বতের জায়গায় আরাবল্লী পর্বত পড়ছিলাম। বড়রা বলেন, ঘুম এলে অঙ্ক করতে হয়, তবে চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়। তাই আমি উঠে একলা পড়ার ঘরে অঙ্ক বই আনতে গিয়েছিলাম। হঠাত্‌ আমি ধপাস করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে জ্ঞান ফিরতে সকলেই জিজ্ঞেস করেছিল আমি কেন অজ্ঞান হয়ে গেলাম, কী দেখেছি? বললে তোরা হয়তো বিশ্বাসই করবি না। আমি দেখেছিলাম কী জানিস? অন্ধকারে রামায়ণের মারীচ রাক্ষসকে তার মা তাড়কা রাক্ষসী ঘরের মেঝেয় আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আমারই অঙ্ক বই খুলে ভগ্নাংশ শেখাচ্ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
দেবদীপ উপহাসের হাসি ঠোঁটে ছড়িয়ে বলল, ‘রাক্ষসী আর ভগ্নাংশের অঙ্ক একদম মেলানো যাচ্ছে না বিনয়। অন্য কিছু বল।’
এমন সময় গামছাকে মাথায় পাগড়ির মতো করে বেঁধে ফতুয়া গায়ে এসে হাজির হলেন অপরেশদাদু। আমরা শুনেছি অপরেশদাদু নাকি ভূত বিতাড়ন মন্ত্র জানে। সব্বাই রাক্ষস দেখে বেজায় ভয় পেয়েছি শুনে দাদু বললেন, ‘এর কোনওটাই রাক্ষস নয় রে, আবার এমনি ভূতও নয়। এদের বলে রাক্ষস-ভূত। এদের নিয়েই তো আমি একটা সমিতি খুলেছি জগত্‌ পাড়ুইদের পোড়ো বাড়িতে। তোদের কোনও ভয় নেই। এই তো এখন সন্ধে হয় হয়। তোদের দেখাতে নিয়ে যেতে পারি। যাবি দেখতে?’
আমরা সকলে ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়ে বললাম, যাব। বিনয় কান্না-ভেজা গলায় আমার কানে কানে বলল, ‘ভয় পাবে না তো রে?’ ভয়টয় ঝেড়ে ফেলে হ্যামেলিনের বাঁশিওলার মতো দাদুর পিছন পিছন আমরা যাচ্ছিলাম।
এমন সময় দেবল দাদুকে প্রশ্ন করে বসল, ‘তোমার সমিতির নাম কী, দাদু?’
দাদুর মুখে একটা গাম্ভীর্য ছড়িয়ে পড়ল। এই আবছা অন্ধকারেও তা আমাদের কারও চোখ এড়াল না। দাদু বললেন, ‘আমার এই সমিতির নাম রেখেছি ‘ভূত প্রতিপালন সমিতি’। সমিতিটমিতি না বলে ভূতেদের হস্টেলও বলতে পারিস। ওরা ওখানে থাকে, খায়দায়, হাসিমজা করে। তবে ওরা ঘুমোয় না।’
আমি কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আমরা সেই বাড়িটার কাছে পৌঁছে গেলাম। তবে আমরা চোখ বড় বড় করে অন্ধকা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.