ধোনির অর্ডারি পিচে না
ধোনির ভারতই বিপন্ন হয়ে পড়ে
নাম ছিল সীতারাম!
কোটলার পিচ বানাতেন পেন্সিল-শীর্ণ ভদ্রলোক। ব্যাটসম্যানদের কাছে অবশ্য তিনি ছিলেন পরম পূজনীয় শালপ্রাংশু রামচন্দ্র! একটা সময় বলা হত, এত ফ্ল্যাট পিচ যে বছরের পর বছর তৈরি করতে সমর্থ তাঁকে সারা দেশে রাস্তা বানাতে পাঠানো হয় না কেন? তা হলেই তো ভারতবর্ষের রাস্তা আর এবড়ো-খেবড়ো হয় না!
সেই রামও নেই। সেই সীতাও নেই। সেই কোটলাও নেই।
অধুনা রাজধানীর আন্তর্জাতিক পিচ তৈরি করেন প্রাক্তন ক্রিকেটার বেঙ্কটসুন্দরম। তাঁর হাতে একান্তই ছেড়ে দিলে বোধহয় এই অবস্থা হত না। কিন্তু এটা তো ফরমায়েশি সারফেস। আর সেই ভারত অধিনায়কের অর্ডারি পিচ তৈরি করতে গিয়ে যা দাঁড়িয়েছে, ম্যাচের দ্বিতীয় দিনেই হরর ছবির মতো! কমেন্ট্রি শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিস্ফারিত ভিভিএস লক্ষ্মণ বলে গেলেন, এত বীভৎস কোটলা উইকেট আর কখনও দেখেননি! সাহস করে কেউ বলতে পারছে না যে চতুর্থ ইনিংসে যদি ১২৫ রানও ভারতকে তাড়া করতে হয়, তা হলেও ৪-০ জিতেই তারা বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি নেবে। নাথন লিয়ঁ তো সাংবাদিক সম্মেলনে বলেই গেলেন, “চতুর্থ ইনিংসে আমাদের একশো রান হাতে থাকলেই যথেষ্ট।” টিপিক্যাল অজি গেমসম্যানশিপ থেকে বললেন কারও মনে হয়নি। কারণ পিচটা সত্যিই খোঁয়াড় হয়ে গিয়েছে।
ফোনে টাচস্ক্রিন থাকলে যেমন চাপ দিতে হয় না, আঙুলটা স্রেফ স্পর্শ করলেই হল। এই উইকেটেও তেমনই। বল ঘোরাবার দরকার নেই। জায়গায় রাখলেই হল। বনবন করে ঘুরবে এবং লাফাবে। নাথন লিয়ঁকে এই সারফেসে দেখাল মুথাইয়া মুরলীধরন! ভারত তবু যদি টেস্টটা জিতে যায়, এখুনি পূর্বাভাস করে রাখছি, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া তার জন্য কেয়ারটেকার ক্যাপ্টেন ওয়াটসনকে দায়ী করবে। ম্যাক্সওয়েলকে আক্রমণে আনা তখন সম্ভব ছিল না। পেট খারাপ না একটা ভাইরাসে অর্ধেক দিনের মতো বাইরে ছিলেন। কিন্তু লিয়ঁকে আনার জন্য তিনি ১৯ ওভার অবধি অপেক্ষা করবেন কেন?
সচিনও যেখানে বেসামাল। ছবি: উৎপল সরকার
সকাল থেকে কপিল দেব বলে যাচ্ছেন, দু’শো করে ফেলল তো ওরা। কেস গড়বড় আছে। রবি শাস্ত্রী দ্রুত জানালেন, তিনিও সহমত। অথচ ভারতীয় ওপেনিং জুড়ি যে ভাবে খেলা ধরে নিল, এঁদের অভিমত তখন হাস্যকর হয়ে পড়ছে। ২৫ ওভারে ১০৬ তুলে দিলেন মুরলী বিজয় আর চেতেশ্বর পূজারা। গোটা সিরিজ চমৎকার সামলাচ্ছেন এঁরা অজি পেসারদের। প্রথম জনের ব্যাটিং গড় যাচ্ছে ৬৯। পূজারার ৬৭।
ভারতীয় ক্রিকেট বিপণনের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি পার্টনারশিপটা দেখতে দেখতে বলছিলেন, “পূজারা এত ভাল খেলছে তো। দেখবেন ওই একটা ব্যাটের এনডোর্সমেন্ট ছাড়া ওর ভাগ্যে আর কিছু জুটবে না। টেস্ট ম্যাচে ভাল খেলে আপনি এখন কেবল শ্রদ্ধাই কুড়োতে পারেন। স্পনসরশিপ নয়। ওটার জন্য নিয়মিত টিভিতে থাকতে হবে। ওয়ান ডে-টি-টোয়েন্টি টিমে জায়গা করতে হবে।”
শুনতে শুনতে মনে হল, এঁদের এই যে জুড়ি গোটা সিরিজ ধরে ক্লার্কের দেশকে জ্বালাল, তাঁদের কি তা হলে হতভাগ্য তকমা পাওয়া উচিত? মুরলী বিজয় তিন ধরনের ক্রিকেটেই ইন্ডিয়া টিমে রয়েছেন। কিন্তু তাঁরও তো আক্ষেপ, নিজের নামে কেউ চেনে না। লোকে ডাকে মুরলী বলে। আসলে তাঁর নাম বিজয়। তামিলনাড়ু ক্রিকেটমহলেও বিজয়কে অত ভাল ভাবে চেনে না কারণ তিনি ক্রিকেট শুরু করেছেন যে বয়সে, সেই বয়সে তেন্ডুলকরের ম্যাঞ্চেস্টার সেঞ্চুরি ঘটে গিয়েছে! অনূর্ধ্ব, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট-ফিকেট খেলেননি। মাঠের বাইরে ফ্ল্যামবয়েন্ট। ক্রিকেট নিয়ে নিরন্তর ভাবনার চেয়ে ফাস্ট গাড়ি, বন্ধুবান্ধবী, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস এগুলোতেই আকর্ষণ। এই মনন বলেই বোধহয় অস্ট্রেলিয়ানদের খ্যাতিকে কোনও পাত্তা দেননি। বিজয়ের সেরা স্ট্রোক মোটেও ড্রাইভ নয়। অতি দ্রুত সুইচ অন-সুইচ অফ করতে পারার ক্ষমতা।
যা শনিবার ভারতের বেলা বারবার ঘটছিল। বিনা উইকেটে ১০৫ থেকে হঠাৎ স্কোর ঘুরে গেল ৫ উইকেটে ১৮০। তেন্ডুলকর আউট।
ভারতের অর্ডারি সারফেসে টিম ইন্ডিয়াই বিপন্ন তখন। অম্বেডকর স্টেডিয়াম প্রান্ত থেকে যখন বল হচ্ছে, বাঁইবাঁই করে সেটা ঘুরছে। ফিল্ড তখন অচিন্তনীয়। সিলি পয়েন্ট, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, স্লিপ, ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ। বল এমন লাফাচ্ছে যে ব্যাটসম্যান ফ্রন্টফুটে যাওয়া মানে লাফিয়ে ব্যাট না হোক বল গ্লাভস ছুঁয়ে যাবে। যেখানে ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ সানন্দে অপেক্ষারত।
অজিঙ্ক রাহানের উদ্বোধনী টেস্ট ইনিংস ওখানেই শেষ হল। তার আগে অবশ্য পিটার সিডলের তীব্র স্লেজিং শুনেছেন। রান নেওয়ার সময় সিডলের সঙ্গে হালকা শোল্ডার চার্জ হয়েছে। আর হেলমেটে বীভৎস জোর একটা খেয়েছেন। আঠারো মাসের ওয়াটার বয় থেকে দুম করে টেস্ট ক্রিকেট। মানাতে সময় লাগারই কথা। তবে টেস্ট ক্রিকেট গ্রহে নতুন অতিথিকে যে ভাবে স্বাগত জানানোর কথা, সে ভাবেই তাঁকে কম সময়ের মধ্যেও একটা ছোট সাইটসিয়িং ট্যুর দেওয়া হয়েছে। সিরিজে এই প্রথম অবস্থা সামান্য অনুকূল দেখে অজিরা তাদের স্লেজিংয়ের সাবেকি ব্যাগি গ্রিন চাপিয়ে ফেলে। ক্লার্ক অধিনায়ক থাকলে এটা হত কি না তর্কের বিষয়। তিনি ভাবমূর্তিকে গুরুত্ব দেন। জঙ্গি ওয়াটসন ও সবের ধার ধারেন না।
একটা সময় মাঠের মধ্যে পুরনো ভারত-অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট আমেজ আমদানি হয়ে যায়। যখন মুহুর্মুহু গালাগাল চলছে জাডেজা আর ওয়ার্নারে। তার আগে প্যাটিনসনের সঙ্গে একচোট হয়েছে জাডেজা-বিজয়দের। ধোনি তার মধ্যেও অবিচলিত। শুধু হাত তুলে ওয়াটসনকে দেখালেন, এ বার একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। দ্রুত দেখা গেল দুই আম্পায়ারে বৈঠক হচ্ছে। প্লেয়ারদের সঙ্গে ফের একপ্রস্থ কথাবার্তা। বারবার ম্যাচে পূর্বনির্ধারিত না থাকা কমা, সেমিকোলন হাজির হয়ে যাওয়া।
শেন ওয়ার্ন বোধহয় খেলা শেষে ঠিকই আন্দাজ করেছেন। “অস্ট্রেলিয়ার এই সিরিজ থেকে আর নতুন করে হারাবার কিছু নেই। আগামী দু’দিন ওরা ঝাঁপাবে যে ভাবে ওয়ান ডে-র শেষ দশ ওভার খেলে।”
আর তিনি ওয়ার্নের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের মাঠে জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে কোন চেহারায় দেখা দেবেন? দক্ষিণ আফ্রিকা যদি যানও, এ দেশে তো মনে হচ্ছে চতুর্থ ইনিংসটাই ভারতের হয়ে শেষ বারের মতো বাইশ গজে আবির্ভাব। পিচ যত খারাপই হোক, ৩২ রানটা মোটেও তেন্ডুলকরোচিত ছিল না। একটা গভীর এলবিডব্লিউ-র আবেদন থেকে রক্ষা পেয়েছেন। যে বলটায় আউট হলেন সেটা যতই দুর্গম প্রান্তের হোক আরও যৌবনে হলে বলটা মনে হয় না প্যাডকে পেত। তার জন্য ব্যাটই অপেক্ষা করে থাকত।
ভারত মাত্র কয়েক রানে এগিয়ে থেকেও স্বস্তিতে নেই। উইকেট আরও খারাপ হয়ে আসছে। সাড়ে তিন দিনে হার-জিতের নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারে। এর চেয়ে ভাল বিদায়ী চিত্রনাট্য আর কী পেতে পারেন।
দিল্লিতে স্রেফ অজিত তেন্ডুলকরের উপস্থিতি নিয়ে তার কারণ সন্দেহে গোটা দেশে যেমন সাড়া পড়ে গেছে, তাতে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট হাতে বেঁটেখাটো চেহারাটা বেরিয়ে এলে কোটি কোটি ক্রিকেটবাসীর মনের ভাব আন্দাজ করা শেষ টেস্টের ভাগ্য সম্পর্কে অনুমানের চেয়ে অনেক সহজ।
‘দাও গো এ বার যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও’!

বাইশ গজ নিয়ে চিন্তা দুই শিবিরেই
সিরিজের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিনটা কি ছিল শনিবারই? নাকি আগামী দু’দিনে আরও আকর্ষণ বাকি? বিকেলে কোটলা জুড়ে এই গুঞ্জন। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, সিরিজের শেষ টেস্টকে যে জমিয়ে দিয়েছে কোটলার ২২ গজ, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। খেলার শেষে অস্ট্রেলীয় শিবিরের নায়ক নাথন লিয়ঁ যখন বলছিলেন, “আমার ভাগ্য ভাল যে, পাঁচ উইকেট পেলাম। কৃতিত্বটা কিন্তু সম্পূর্ণ আমার নয়”, তখন বোঝাই গেল কী বলতে চাইছেন তিনি। কোটলার উইকেটই যে আগামী দু’দিনে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তা মেনে নিয়েই লিয়ঁ বলেন, “ম্যাচ যত গড়াবে, এই উইকেটে ব্যাট করা তত কঠিন কাজ হয়ে উঠবে। এখনই ব্যাট করা বেশ শক্ত। ওদের আউট করে দেওয়ার পর আমাদের তবু ভাল ব্যাট করতে হবে। চতুর্থ ইনিংসে কিন্তু একশো রান তাড়া করাই মুশকিল হয়ে উঠবে।” তা হলে ভারতের ৪-০-য় সিরিজ জয়ের স্বপ্নের কী হবে? আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ক্রিকেট মহলে। অনেকে দিল্লি ক্রিকেট সংস্থার কর্তাদের দুষছেন, কিন্তু ভারতীয় দলের প্রাক্তন স্পিনার মনিন্দর সিংহের বক্তব্য, “এতে ডিডিসিএ-র কী করার আছে? ওরা তো নির্দেশ পালন করেছে মাত্র। এই উইকেটে শেষে ব্যাট করে ভারত ম্যাচ বের করতে পারবে কি না, সন্দেহ রয়েছে। এটা আগেই ভাবা উচিত ছিল। এই ধরনের উইকেট তৈরি করে কেন আমরা ওদের ৩-১ করার সুযোগ দিচ্ছি, জানি না।” ভারতীয় ওপেনার মুরলী বিজয় অবশ্য যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। বললেন, “উইকেট যে অবস্থাতেই থাকুক, টার্গেট যাই হোক, শেষে ব্যাট করে তুলে নিতে পারব।” তবে মেনে নিলেন, “উইকেট ক্রমশ স্লো, লো হচ্ছে। ফাটল বাড়ছে। বলের গতি বোঝা বেশ কঠিন হয়ে উঠছে। এখানে রান তোলা খুব কঠিন।”

অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস
(আগের দিন ২৩১-৮)
সিডল বো অশ্বিন ৫১
প্যাটিনসন ক কোহলি বো প্রজ্ঞান ৩০
লিয়ঁ নঃআঃ ৮
অতিরিক্ত ১২
মোট ২৬২।
পতন: ৪, ৭১, ১০৬, ১১৫, ১১৭, ১২৯, ১৩৬, ১৮৯, ২৪৩।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৯-১-৪৩-০, ইশান্ত ১৪-৩-৩৫-২,
অশ্বিন ৩৪-১৮-৫৭-৫, প্রজ্ঞান ২৬.১-৬-৭৫-১, জাডেজা ২৯-৮-৪০-২।

ভারত
প্রথম ইনিংস

বিজয় ক ওয়েড বো সিডল ৫৭
পূজারা বো লিয়ঁ ৫২
কোহলি এলবিডব্লিউ লিয়ঁ ১
সচিন এলবিডব্লিউ লিয়ঁ ৩২
রাহানে ক স্মিথ বো লিয়ঁ ৭
ধোনি ক ওয়াটসন বো প্যাটিনসন ২৪
জাডেজা এলবিডব্লিউ ম্যাক্সওয়েল ৪৩
অশ্বিন এলবিডব্লিউ লিয়ঁ ১২
ভুবনেশ্বর ব্যাটিং ১০
অতিরিক্ত ২৮
মোট ২৬৬-৮।
পতন: ১০৮, ১১৪, ১৪৮, ১৬৫, ১৮০, ২১০, ২৫৪, ২৬৬।
বোলিং: জনসন ১৭-৩-৪৪-০, প্যাটিনসন ১৪-১-৫৪-১,
সিডল ১২-৩-৩৮-১, লিয়ঁ ২২.১-৩-৯৪-৫, ম্যাক্সওয়েল ৩-০-৮-১।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.