প্রাক্তন শাসকের হাতিয়ার ভাঙড়-গার্ডেনরিচ-ধাপা। বর্তমানের অস্ত্র নন্দীগ্রাম-নেতাই-ছোট আঙারিয়া। কার আমলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশি খারাপ, এই নিয়ে তীব্র চাপান-উতোর বাধল বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের শেষ দিনে। বিতর্কের মীমাংসা না হলেও দিনের শেষে বামেদের মুলতবি প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেল ১২৫-৫৩ ভোটে। এই পরিস্থিতিতে কোন দিকে যাওয়া উচিত, ঠিক করতে না পেরে ভোটই দিল না কংগ্রেস।
বিধানসভায় তাদের আসন শাসক তৃণমূল এবং প্রধান বিরোধী বামেদের মাঝখানে। মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাতেও তাদের অবস্থান ছিল একই রকম মধ্যবর্তী! জাতীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে কংগ্রেসের এই ভূমিকা তৃণমূলের প্রতি কোনও ভাবে বার্তাবাহী কি না, সেই জল্পনায় অবশ্য আমল দিতে রাজি নন কংগ্রেস পরিষদীয় নেতৃত্ব।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে এ দিনই প্রথম আলোচনা হল বিধানসভায়। খোদ মুখ্যমন্ত্রীই তাতে উপস্থিত না থাকায় ক্ষোভ জানান প্রস্তাবের উত্থাপক বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। কাটোয়ার বর্ষীয়ান বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তার আগেই বিধানসভার রীতিভঙ্গ নিয়ে সরাসরি অভিযুক্ত করেন মুখ্যমন্ত্রীকে।
রাজ্যপালের বক্তৃতার উপরে বিতর্ক চলাকালীন মুখ্যমন্ত্রী দু’দফায় জেলা-সফরে ব্যস্ত ছিলেন। বিতর্কের শেষ পর্বে মমতার উপস্থিতিতেই রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “বিধানচন্দ্র রায় থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত সব মুখ্যমন্ত্রী এই বিতর্কের সময় বিধানসভায় থাকতেন। লিখিত নিয়ম নেই। তবু এটা দীর্ঘদিনের প্রথা। এটা ভাঙা হোক, চাই না। মুখ্যমন্ত্রী সভায় থাকুন, আমাদের বক্তব্য শুনুন।”
রবীন্দ্রনাথবাবুর বক্তব্য শুনে নিজের বক্তৃতায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বিধানচন্দ্রের সঙ্গে যে ভাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে এক করে দেখানো হচ্ছে, আমি স্তম্ভিত, দুঃখিত! আমিও কংগ্রেস করেছি।
এটা মানতে পারি না। ভাবতেও পারিনি!” কংগ্রেসের তরফেই বোঝানোর চেষ্টা হয়, এটা তুলনা নয়। রবীন্দ্রনাথবাবু একটি প্রথার কথা বলেছেন মাত্র। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তাঁদের চুপ করিয়ে দেন।
দ্বিতীয়ার্ধে সরকার সম্পর্কে মানস ভুঁইয়ার সুর ছিল অনেক নরম। বাম জমানার ৩৪ বছরের নানা ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি সবে যখন তৃণমূলের ২২ মাসে ঢুকছেন, তখনই সময় শেষ! তার মধ্যেই অবশ্য মানসবাবু প্রশ্ন তোলেন, “বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কি বামফ্রন্ট আমলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই অনুসরণ করবেন?”
ভোটাভুটিতে তাঁদের অংশ না নেওয়া কি জয়রাম-কমলনাথদের ফোন-দৌত্যের জের?
সভার বাইরে মানসবাবুর জবাব, “ফোনের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। হাত ওরাই (তৃণমূল) কেটেছিল। আবার জুড়বে কি না, জানি না! তবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে এমন প্রস্তাব আনার অধিকার বামেদের নেই। তাই ওই প্রস্তাবে ভোট দিইনি।” আর সূর্যবাবুর মন্তব্য, “কংগ্রেস-তৃণমূল এক বৃন্তের দুই কুসুম। কংগ্রেস ভোট দেয়নি, এতে আশ্চর্যের কী আছে?”
তৃণমূলের পরশ দত্ত, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এ দিন বাম জমানার নানা দৃষ্টান্ত পেশ করেন। কিন্তু দলের লোকেরই তাঁর কলার চেপে ধরার কথা তুলে শোভনদেবকে পাল্টা বিড়ম্বনায় ফেলেন সূর্যবাবু। মানসবাবুও সরকারি মুখ্য সচেতকের উদ্দেশে বলেন, “আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনি কিন্তু বিচার পাননি!” ফরওয়ার্ড ব্লকের উদয়ন গুহ মন্তব্য করেন, “কালীঘাটের ব্যানার্জি, কীর্ণাহারের মুখার্জি আর জঙ্গলমহলের কিষেণজি এক ছাতার তলায় না-এলে এই সরকার ক্ষমতায় আসত না! মুখ্যমন্ত্রী নিজের দলকে সংযত করুন! তা হলে ঘটনাগুলোই ঘটে না।” শোভনদেব আবার উদয়নকে খোঁচা দেন দিনহাটা-প্রসঙ্গ তুলে। আরএসপি-র সুভাষ নস্কর বলেন, “বামফ্রন্টে আমরা তা-ও আলাদা দল। আপনাদের স্বদলীয় সংঘর্ষে কত লোকের ক্ষতি হচ্ছে?”
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বামেদের কথা বলা সাজে না বলে দাবি করেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রস্তাবের জবাবিতে সূর্যবাবু বলেন, “শুধু বামপন্থীরা মার খাচ্ছেন বলে আমরা প্রস্তাব আনিনি। কংগ্রেস, এমনকী তৃণমূলও আক্রমণের শিকার। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই এই প্রস্তাব।” |
