ভোট সেই দু’দফায়, কমিশনকে এড়িয়েই দিন ঘোষণা রাজ্যের
কতরফা ভাবে পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা করে দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কোর্টে বল ঠেলে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
শুক্রবারই বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দু’-এক দিনের মধ্যেই পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা হবে।” আর সন্ধ্যায় মহাকরণে দাঁড়িয়ে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, আগামী মাসের ২৬ ও ৩০ তারিখ দু’দফায় পঞ্চায়েত ভোট হবে।
সরকারের এ দিনের ঘোষণার ফলে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই গেল বলে মত প্রশাসনের একাংশের। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন কমিশন অবশ্য এ দিন কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কমিশনের সচিব তাপস রায় বেশি রাতে বলেন, “আমরা এখনও কোনও চিঠি পাইনি। সোমবার বসে সিদ্ধান্ত নেব।”
সব মিলিয়ে আপাত সংঘাতের আবহ। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের অনেকেই মনে করছেন, সংঘাতের আড়ালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে খানিকটা নরম হওয়ার পথেই হাঁটল রাজ্য সরকার। কী ভাবে? প্রথমত, কমিশন প্রথম থেকেই ‘অবাধ ও শান্তিপূণর্’ ভোটের স্বার্থে তিন দিনে পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোর কথা বলে। রাজ্য কিন্তু দীর্ঘদিন এক দিনে ভোট করানোর ব্যাপারে অনড় ছিল। পরে অবশ্য তারা খানিকটা সুর নামিয়ে দু’দিনে ভোট করতে সম্মত হয়। দ্বিতীয়ত, কমিশন প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহারের কথা বললেও রাজ্য জানিয়েছিল, নিজস্ব পুলিশ দিয়েই ভোট হবে। এ দিন সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভোটে ভিন রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশ আনার চেষ্টা চলছে।” সব মিলিয়ে, কোথাও একটা সুর নরম করার ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের একাংশ। এর উল্টো মতও রয়েছে। অন্য একটি অংশের বক্তব্য, এ দিনের পরে সংঘাতের সম্ভাবনা আরও বাড়ল।
কেন? প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, ভোটের দফা ও বাহিনী নিয়ে দু’পক্ষ কোনও সময়েই সহমত হতে পারেনি। কমিশন বরাবর তিন দফায় ভোট করাতে অনড়। রাজ্য প্রথমে এক দফায় ভোট চাইলেও অনেক টানাপোড়েনের শেষে দু’দফায় রাজি হয়। সে ক্ষেত্রে একটি দফায় কংগ্রেস প্রভাবিত তিন জেলাকে রেখেছিল তারা (এ দিনের ঘোষণার পরে দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তেই অনড় রইল রাজ্য)। এই নিয়ে দিন পনেরো আগে কমিশনকে চিঠিও দেন মুখ্যসচিব। সেখানে ১৪ এবং ২৭ এপ্রিল ভোট চাওয়া হয়েছিল। এ দিন সেই তারিখও বদলে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে কমিশনের চাহিদাকেও রাজ্য মর্যাদা দেবে কি না, সংশয় রয়েছে। ফলে সংঘাতের আবহকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলেই প্রশাসনের ওই অংশটির বক্তব্য। এক কমিশন-কর্তা বলেন, “শান্তিপূর্ণ ভোটের স্বার্থেই উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ ও জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে এক এক দিন ভোট করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, পর্যাপ্ত পুলিশ থাকলে মানুষ ভোট দিতে ভরসা পাবেন।”
এখন প্রশ্ন, মতভেদ হলে কমিশন কী করতে পারে? মহাকরণের একাধিক অফিসার মনে করছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনের ৪৩ ধারা মেনে সরকারকে বিজ্ঞপ্তি পুনর্বিবেচনা করার কথা বলতে পারে কমিশন। এর পরেও সরকার নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে বিষয়টি আদালতে গড়াতে পারে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “পুরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কর্নাটক সরকারের সঙ্গে সেখানকার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এ রকমই বিরোধ বেধেছিল। সেই বিরোধ গড়িয়েছিল এমনকী সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। শেষে কমিশনের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দিয়েছিল আদালত।” প্রশাসনের একাংশ বলছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কমিশনকে। তাতে বলা আছে, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা তৈরি হলে তা দূর করতে কমিশন যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের পরামর্শ নিতে বাধ্য নয় তারা। তাঁদের বক্তব্য, ওই আইনবলেই রাজ্যের প্রস্তাব কমিশন তিন তিন বার ফিরিয়ে দিয়েছে।
প্রশাসনের অধিকাংশ কর্তাব্যক্তিই মনে করছেন, দু’পক্ষের সংঘাত আদালতে গড়ালে পঞ্চায়েত ভোটের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। কবে ভোট হবে, সেটা তখন বলা মুশকিল হবে।
এ দিন রাত পৌনে ৮টা নাগাদ রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও পঞ্চায়েতসচিব সৌরভ দাসকে নিয়ে মহাকরণে বৈঠকে বসেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এর আগেই বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের ফাঁকে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক প্রস্থ বৈঠক করেন সুব্রতবাবু। বিধানসভা থেকে বেরনোর আগেই মুখ্যমন্ত্রী ইঙ্গিত দেন, দু’-এক দিনের মধ্যেই পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা হবে। তারই সূত্র ধরে রাতে মহাকরণে বৈঠক করেন সুব্রতবাবু। একই সঙ্গে তিনি জানান, পঞ্চায়েত আইনবলে এ দিনই ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিল রাজ্য সরকার।
রাজ্য যে কংগ্রেস প্রভাবিত তিন জেলায় এক দিনে ভোট করার কথা ঘোষণা করেছে, তার পিছনে ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’ আছে বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের অভিযোগ। প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে নগ্ন দলবাজির জন্য এই প্রস্তাব রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাল সরকার। দু’-এক দিনের মধ্যে কমিশনের সঙ্গে দেখা করব আমরা।” শুক্রবারই প্রদীপবাবু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী না পাঠালে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব নয়।” রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “রাজ্য সরকার পরিহাস করেছে। তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সি ও আবু হাসেম খান চৌধুরীর তিন জেলায় এক দিনে ভোট রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক।” তিনি জানান, শুধু রাজ্য নির্বাচন কমিশনারই নন, কংগ্রেস রাজ্যপালের কাছেও যাবে। কংগ্রেসের স্পষ্ট দাবি, তিন দফায় এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হোক।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিনের সরকারি ঘোষণা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব বলেন, “নির্বাচন কমিশন কী করে দেখি, তার পরে প্রতিক্রিয়া জানাব। তবে মমতার সরকার কোনও নিয়ম-নীতি মানছে না।” রাজ্যের প্রাক্তন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য জানান, বাম আমলে অফিসারেরাই ভোটের দিন ঘোষণা করতেন। ওরা যা করল, তা অনুচিত হয়েছে। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও অভিযোগ, “এই ঘোষণা অসাংবিধানিক। আমরা এর বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হব।” বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। রাতে মহাকরণে তিনি বলেন, “কমিশনের সঙ্গে বহু বার আলোচনা করেই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের স্বার্থে এই সূচিই সবচেয়ে ভাল বলে মনে করেছে রাজ্য।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.