|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ৩... |
|
ভাষার কী বাহার কী বাহার |
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় |
দেশ-শব্দটা ‘দ্যাশ’ হয়ে যায় কোন ভাষায়? আমার মতো জাতঘটিরা বলবেন, পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ ভাষা। সেই ভাষায় লেখা কয়েকটি গল্পের সংকলন দ্যাশের ভাষায় গল্প (সম্পা: জীবন সরকার, অনসূয়া কর। কোডেক্স, ১৮০.০০)। পূর্ববঙ্গের ধারণাটা অবশ্য দিয়েছে ভাষা নয়, রাজনীতি। দেশভাগের আগে রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া ছিল উত্তরবঙ্গে, যশোহর-খুলনা দক্ষিণবঙ্গ; পাবনা-কুষ্টিয়াকেও ঠিক পূর্ববঙ্গ বলে ধরা হত না। ভাঙা বাংলায় পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ-এ যে-মানচিত্র তৈরি হয়েছে, সেখানে অঞ্চলে-অঞ্চলে ভাষাবৈচিত্র এতই বিপুল যে, কোনও একটা নাম দিয়ে সে ভাষাকে বোঝানো যাবে না। সাহিত্যমূল্যের চেয়েও এই বইয়ে বড় হয়ে উঠেছে মুখের ভাষার সেই আশ্চর্য রূপবৈচিত্র। পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষার সঙ্গে কি তার কোনও মিল-ই নেই? রাজনীতি কি ভাষাকে ভাগ করতে পারে!
রংপুরের গল্পে মোক, মুই, করিনু, আর ‘ভাবের দ্যাওরা’ শুধু কোচবিহার-জলপাইগুড়ি কেন, মনে পড়ায় অসমের গোয়ালপাড়ার গান-ও। কাথা-শব্দটি তো আবার রাঢ়ের সাঁওতাল-মুন্ডাদেরও মুখের ‘কথা’। মুর্শিদাবাদে শুনেছি: নামোত; আর রাজশাহির গল্পে পড়ছি: নিচত। দক্ষিণবঙ্গে ‘র’ অনেক সময়ই ‘অ’ হয়ে যায়; রাজশাহিতেও কিছু পাচ্ছি: আস্তাঘাট। ময়মনসিংহের ভাষায় যে ক্রিয়াপদ একটু বিশেষ রকমের হয়, জানা ছিল। এখানে পরিষ্কার মিলিয়ে নিতে পারি: যাইয়ান= যাব, যাইবাইন= যাবেন, চিনবাম= চিনব। বেশ বুঝে নিতে পারছি ঢাকার চইল্যা-লাইগ্যা-নিবত্যাছে বা এহানে (এখানে)। বরিশালেও পাচ্ছি: যহন, ডাইক্যা; ফরিদপুরে শরিল, বেথা; আর পোলা-মাইয়া-মাইন্ষ তো খুবই চেনা।
শ্রীহট্ট বা সিলেটের ভাষায় ও-র উচ্চারণ ‘উ’ হয়ে যায় (ভোগ= ভুগ); এখানে দেখছি আর একটা ধরন। ঝোল: জুল। ঝ-এর জায়গায় এল তার ঠিক আগের বর্ণটি; ঢাকাতেও পেয়েছি: ওটে (ওঠে)। সিলেটে পরের বর্ণটাও আগিয়ে (আউগাইয়া) আসে পিরিত হয় ফিরিত। বিদেশে যেতে হলে ‘ফাসফোর্ট লাগে, বিসা লাগে’ (পৃ: ৪৬) পড়ে মনে হল, বর্ণের জায়গাবদলের একটা নিয়ম-ই পেয়ে গেলাম বুঝি। ও হরি! তারপরই পড়ছি: দরগার (দরকার) ক খ-কে ডিঙিয়ে টেনে এনেছে গ-কে। তাইতো, ‘হালার পুত’-এ শ পরের দুটো বর্ণকে পাত্তা না দিয়ে নিয়ে নেয় হ-কে। নোয়াখালির লেখক জানাচ্ছেন, শুধু শ নয়, প-ও ‘হ’ হয়ে যায় সে-দ্যাশে (পৃ: ১৭৭)। সাধে কি সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ভাষা জিনিসটাই একটা ‘আজগুবি’ ব্যাপার! সত্যি, কী বাহার, কী বাহার! কোনও গল্প পুরোটাই আঞ্চলিক ভাষায় লেখা; কোথাও শুধু সংলাপ। খাঁটি নোয়াখাইল্যার নমুনা দিয়েছেন দীনেশচন্দ্র সিংহ: পাকিস্তান সেখানে হাকিস্তান! চমৎকার সংকলন। প্রচ্ছদে বরিশালের পুতুল বা ফরিদপুরের আলপনা বাদ দিয়ে কালীঘাট পটের আদল কেন? |
|
|
|
|
|