|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
অপ্রতুলতার বিশ্বস্ত দলিল |
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কী ভাবে পরাধীন ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে, দাঙ্গার রক্তক্ষয় ও দেশ-ভাগের বিপর্যয়ের মূল্যে উপমহাদেশের জনগণ তা বিলক্ষণ উপলব্ধি করেছেন। ১৯৪৬ সালের সেই ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’, ১৬ অগস্টের কলকাতা, তারপর অক্টোবরের নোয়াখালি, নভেম্বরের বিহার একের পর এক দাঙ্গায় গোটা ভারতই তখন জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ। প্রতিবেশীকে কুপিয়ে কাটার, ধর্ষণ করার, আগুনে পোড়ানোর সেই পৈশাচিকতার কেন্দ্রে থেকেছে উপনিবেশবাদীদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি আর দ্বিজাতিতত্ত্ব ভারতীয় মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে শনাক্ত করে তাদের জন্য পৃথক স্বদেশভূমির দাবিতে আন্দোলন এবং হিন্দুদের তরফে সেই আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা।
মুসলিম লিগের সেই আন্দোলনের অংশ হিসাবেই পরবর্তী কালে আওয়ামি লিগেরও জন্ম। মুজিবর রহমান সহ আওয়ামি নেতারা মুসলিম লিগের কট্টরপন্থী অংশের রাজনৈতিক দর্শন ও ঐতিহ্যই উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে নিয়ে যান। কিন্তু নবার্জিত পাকিস্তানের মুসলিম লিগ সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা-সংস্কৃতির উপর পশ্চিমের উর্দুকে চাপিয়ে দিতে থাকে, পূর্বের প্রতিনিধিত্ব ও প্রয়োজনকে পশ্চিমের অগ্রাধিকারের হাড়িকাঠে বলি দিতে থাকে, তখনই আওয়ামি লিগের নেতারা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতে থাকেন। ক্রমে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্বের স্বায়ত্তশাসনের দাবিও তুলতে থাকেন। হিন্দু আধিপত্যের যে-ভারত থেকে স্বাধীন হতে একদিন লিগ নেতৃত্বের সৌজন্যে তাঁরা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক হয়েছিলেন, মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হতে আওয়ামি লিগের নেতারা এ বার সেই ভারতেরই সাহায্য নেন। মহম্মদ সফিকুল ইসলাম রচিত কেতাব আওয়ামী লীগ: পাকিস্তান-সমর্থক থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠকে রূপান্তর-এ (উদার আকাশ, ৩০০.০০) সেই রূপান্তরের ইতিকথাই তুলে ধরা হয়েছে।
মোহিত রায় ইতিহাসের এই প্রেক্ষিত নিয়ে ততটা চিন্তিত নন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলিম হামলা, হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস, পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যার বাড়বৃদ্ধি এবং মুসলিম-তোষণের সরকারি-রাজনৈতিক উদ্যোগ তাঁকে যারপরনাই উদ্বিগ্ন ও রুষ্ট করেছে। রাজ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার রমরমা, ইমাম-মুয়েজ্জিনদের ভাতার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক মঞ্চে ইমামদের নিয়মিত উপস্থিতি, বাংলা ভাষায় মুসলিম দৈনিক পত্রিকার প্রকাশ, এমনকী অনগ্রসর মুসলিমদের জন্য চাকরিতে সংরক্ষণের বন্দোবস্তও তাঁর উৎকণ্ঠা ও রক্তচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, কেন রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ বা লোকনাথ আশ্রমের মতো হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন এবং ‘সদাবিপ্লবী লিট্ল ম্যাগাজিনেরাও’ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থাকছে। তাঁর এই বিস্মিত জিজ্ঞাসা নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াণযাত্রা’র কিছু কথা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ/ কিছু বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ (ক্যাম্প, ৮০.০০)।
চন্দনকুমার কুণ্ডুর পিএইচ ডি থিসিস দাঙ্গা ও দেশভাগ নিয়েই। বাংলা উপন্যাসে (ছোটগল্পে নয়) এই ঘটনাবলির প্রভাব নিয়েই তাঁর কাজ। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, বনফুল, তারাশংকর, সমরেশ বসু, প্রফুল্ল রায়, জ্যোতির্ময়ী দেবী, গৌরকিশোর ঘোষ প্রমুখের উপন্যাসে দাঙ্গার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কী ভাবে ফুটে উঠেছে, কেমন করে নিষ্ঠুর অমানবিকতার মধ্যেও জেগে উঠেছে বিবেকের দংশন, প্রায়শ্চিত্তের তাগিদ, আত্মধিক্কারের মহত্ত্ব, সবিস্তারে এই বইয়ে তা তুলে ধরেছেন গবেষক।
দাঙ্গা ও দেশ-ভাগ বিষয়ক উপন্যাস বাংলায় বিশেষ লেখা হয়নি, এটা যে তথ্য হিসাবে ঠিক নয়, এই গবেষণা তার প্রমাণ। হয়তো ওয়াপসি সিধওয়া, ইন্তিজার হুসেন, কৃষ্ণা সোব্তি, ভীষ্ম সাহনি, কমলেশ্বর কিংবা অমর কথাকার সদত হসন মন্টোর মতো পশ্চিম প্রান্তের দেশ-ভাগ বিষয়ে রচিত সাহিত্যের তুলনায় বাংলার ভাণ্ডার তত সমৃদ্ধ নয়। তবে সেই ভাঁড়ার একেবারে শূন্যও কিন্তু নয়। চন্দনকুমার কুণ্ডুর বই ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও দেশভাগ: বাংলা উপন্যাসের দর্পণে (বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০০.০০) সেই অপ্রতুলতারই বিশ্বস্ত দলিল। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক দীর্ঘ তালিকাও (অষ্টাদশ শতকের সূচনা থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত) সংযোজিত হয়েছে বইটিতে। |
|
|
|
|
|