|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
সাংস্কৃতিক ইতিহাসের স্বচ্ছচিত্র |
মুহিত হাসান |
সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি-সাধক, আনিসুজ্জামান। বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড (ঢাকা), ৩২৫.০০ |
চেনা মানুষের মুখ, আনিসুজ্জামান। প্রথমা প্রকাশন (ঢাকা), ৩২০.০০ |
বাংলাদেশের বৌদ্ধিক ও সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে আনিসুজ্জামানের ব্যক্তিজীবন ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে এ কথা আশা করি অত্যুক্তি বলে গণ্য হবে না। কৈশোর পার হতে না হতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন বাহান্ন-র ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলন পরবর্তী সাংস্কৃতিক ঘটনাবলির সঙ্গে। এরই পরপর এসে পড়ে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষের উৎসব পালন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সহ ক্রান্তিকালের বেশ কিছু তাৎপর্যময় ঘটনা। চূড়ান্ত ভাবে, শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বলা বাহুল্য, ইতিহাসের এই সব জরুরি মুহূর্তে আনিসুজ্জামান নিজের লেখনী দ্বারা অন্যতম এক সাংস্কৃতিক-কাণ্ডারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যে অসামান্য অভিনব সংবিধানটি পেয়েছিল, সেটির নেপথ্য নায়কদেরও একজন তিনি।
সম্প্রতি প্রকাশিত হল তাঁর নবতম প্রবন্ধগ্রন্থ সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি-সাধক। বইয়ে অন্তর্ভুক্ত একুশটি প্রবন্ধ নানা সময়ে লেখা হলেও, একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই তাদের চলাফেরা সেটি হল, বাংলার সংস্কৃতির নানা উপাদান ও তার সেবকদের কর্মের আন্তরিক মূল্যায়ন। লেখক চিহ্নিত করে না দিলেও, সূচিপত্রের অবয়ব থেকে বোঝা যায়, বইটির মোট তিনটি ভাগ। প্রথম ভাগে রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির কয়েকটি দিক নিয়ে কিছু রচনা, দ্বিতীয় ভাগে লভ্য বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন কৃতী ব্যক্তির প্রসঙ্গ এবং তৃতীয় ভাগে বাংলাদেশের ছয়জন বিখ্যাত শিল্পীর জীবন ও কর্মের উষ্ণ মূল্যায়ন। প্রথম ভাগে গ্রন্থিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান দুটি লেখা নিঃসন্দেহে ‘বাঙালি সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ ও ‘স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি’। বাঙালির সংস্কৃতির কথা বহুবচনে বলার ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আনিসুজ্জামান, এর ভিতরকার ভেদ ও বৈচিত্রের দিকে নজর দিয়েছেন। কিন্তু ভুলে যাননি ভেদ সত্ত্বেও তার ঐক্যের কথা। তাঁর মতে, ‘এই ঐক্য সৃষ্টিতে ভাষার অবদান হয়তো সবচেয়ে বেশি।’ আবার সাংস্কৃতিক গৌরবের দিকটিকেও জাতিগত ঐক্যের আর একটি হেতু হিসেবে অবহেলা করা যায় না মোটেও। এ সব কারণেই সম্ভবত ধর্মের ফারাককে দূরে সরিয়ে মানবিকতা, মানবপ্রাধান্যকেই বাঙালি সংস্কৃতি যুগে যুগে বরণ করে নিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আকাশ-সংস্কৃতির দৌলতে ইংরেজি সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে কি না, তা নিয়ে বিদ্বৎসমাজে একটা তর্ক বেশ চালু থাকলেও আনিসুজ্জামান কিন্তু অযথা দরজা-জানালা বন্ধ না করে রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ‘নিজের সংস্কৃতির সাথে বাইরের যা সহজে মানিয়ে যায়, তা আত্মস্থ হয়, বাকিটা ঝরে পড়ে— এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।’
প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে আনিসুজ্জামানের আর একটি গদ্যগ্রন্থ, চেনা মানুষের মুখ। বইটির ধরন বা গড়নে রয়েছে খানিকটা স্বাতন্ত্র্য। মোহাম্মদ আকরম খাঁ থেকে শুরু করে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বা শামসুন নাহার মাহমুদ থেকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ— বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কথকতা এর মূল উপজীব্য। তাঁদের নিয়ে নিছক জীবন-কর্মের আলোচনা বা স্মৃতিচারণে আবদ্ধ থাকতে চাননি লেখক। বরং স্মৃতি ও কৃতির কথা মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজের কয়েকজন বিস্মৃত অথচ স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের ব্যবচ্ছেদ করেছেন যুক্তির ছুরি দিয়ে। এঁদের নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ আনিসুজ্জামান করেছেন ঠিকই, কাছ থেকে চেনার ও আলাপের সুবাদে তা সঙ্গতই, কিন্তু কখনও যুক্তির শৃঙ্খলকে টালমাটাল হতে দেননি তিনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র-গঠনে এঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের কথা তিনি স্মরণ করেন সবটুকু শ্রদ্ধাসমেত, অথচ তাঁদের সঙ্গে নিজের কোনও দ্বিমতের কথা বুদ্ধি করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। নিজের মতটিকেও উপস্থাপন করেন নম্র ভাবে, আন্তরিকতার স্পর্শ যেখানে থাকে পরতে পরতে। যেমন ধরা যাক, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে এমনিতেই অনেক মিথ চালু বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিক মহলে— এই বইয়ে কিন্তু আনিসুজ্জামান সেই সব মিথের কচকচিকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে নিজের স্মৃতি দিয়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের মূল্যায়নে সচেষ্ট। কোথায় আবদুর রাজ্জাকের বিশিষ্টতা, কোন জায়গায় ঠিক তাঁর প্রতিভার আলো ঠিকরে পড়েছে, তা তিনি আমাদের কাছে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেন। এ ভাবেই আঠাশ জন ব্যক্তির কৃতির বিশ্লেষণ ও স্মৃতির উন্মোচনের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটা বিশেষ পর্বের স্বচ্ছচিত্র দেখতে পাই। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা ছিল যাঁদের, তাঁদের একাংশের চালচিত্র সম্পর্কেও স্পষ্ট অবহিত হই। |
|
|
|
|
|