শনিবারের নিবন্ধ
এ বছর মল্লিকার জন্মদিনে দোল
বালক থেকে বৃদ্ধ প্রত্যেকের একটা আঁচল থাকে। আমরা বাপ-বেটা সেটা হারিয়ে ফেলেছি। ছোটবেলায় মায়ের সাদা থানের খুঁট দিয়ে আমি চোখ মুছেছি। লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে রোরোকে দেখেছি সকালে উঠে মা কোথায় বলে মল্লিকার শাড়ি জড়িয়ে কাঁদত। মল্লিকা তখন সকালবেলার কলেজে ক্লাস নিচ্ছে। আমি সুমনের ‘তোমাকে চাই’ চালিয়ে ওকে সেরেল্যাক খাওয়াতাম। কিন্তু আমি মল্লিকার আঁচল দিয়ে কী করতাম? রাতে বাড়ি ফিরে সারা দিনের অপমান মুছতাম। আমাদের সেই আঁচলটা একটা নৈঋতের দিকে চলে গিয়েছে।
মানুষের শোক এবং হানিমুন দু’টোর একটাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শোক দীর্ঘস্থায়ী হলে পৃথিবীতে যত হাসপাতাল আছে তার দশ গুণ হাসপাতাল বানাতে হত। আর হানিমুন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলে দিঘা এগিয়ে আসত রাইটার্স বিল্ডিং পর্যন্ত। মল্লিকা চলে গিয়েছে। রেখে গিয়েছে ২৬টি বই। ভুল বললাম। রোরোকে নিয়ে ২৭টি বই। প্রতিটি মানুষ আসলে একটি বই। প্লেনে বা পার্কে বা থিয়েটারে যখনই কেউ আমার পাশে এসে বসেন, আমি মনে মনে বলি এই তো একটি বই এসে আমার পাশে বসল। নারী দিবস চলে গেল। নারী অ্যাক্টিভিস্টরা গলা তুলে অনেকে ছক্কা মারলেন। দেখলাম তাঁরা কেউ মল্লিকার কথা বললেন না। অবশ্য তাঁরা কেউ কবিতার ধার ধারেন না। মল্লিকা জীবনের অমোঘ তিরিশটি বছর ছাই করে কবিতা লিখে মেয়েদের লাস্য এবং আগুন, রান্নাঘর এবং কম্পিউটারের মাঝখানে উঠে দাঁড়ানো কথামানবীকে আবিষ্কার করে গিয়েছে। কেউ তাঁর নাম নিল কি নিল না, তা নিয়ে আমার দুঃখ থাকলেও মল্লিকার কোনও দুঃখ নেই আমি জানি। কেননা মল্লিকা জানত এটাই বাস্তব। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন, যারা প্রায় আটশো ছেলেমেয়েকে অর্থ সাহায্য করেন দেশ-বিদেশ থেকে, এত বড় কাজ ভারতবর্ষে আর কোথাও হয় কি না জানি না। এই সেদিন ওরা মল্লিকার নামে পুরস্কার দিল গ্রাম থেকে পড়তে আসা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া চারটি মেয়েকে। একজনকে মল্লিকার শেষ বই ‘কবির বৌঠান’-এ সই দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি মল্লিকার কোন বইটি পড়েছ?” আমাকে অবাক করে মেয়েটি মাথা তুলে আমাকে বলল,
‘গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আপনাকে মানায় না এই অবিচার
আপনি বলুন মার্কস
মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?’
আমার চোখে জল চলে এল। আমি সানগ্লাস পরে হাঁটতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে ফোন পাই অসম থেকে, মালদা থেকে, পুরুলিয়া থেকে, রাজশাহি থেকে মল্লিকার ওপর পিএইচ ডি হচ্ছে। শুনে ভাল লাগে।
মল্লিকা সোনা পরত না। কাঠের গয়না, মাটির গয়না পরে ঘুরে বেড়াত। সাতশো স্কোয়ার ফিট-এর সংসারকে সে ধানের ছড়া, মাদুর, তালপাতা, ত্রিপুরার বাঁশি, ঝাড়গ্রামের তিরধনুক দিয়ে সাজিয়েছিল। সোনা পরো না কেন বলে যদি কেউ বকত, মল্লিকা বলত এই তো আমার সাতশো ফিটের সোনা। ধানের ছড়া কি সোনা নয়? এখনও ধানের ছড়া লাগানো রয়েছে। রোজ সকালে একটা চড়ুই আসে। তার পেছন পেছন আরও দু’টো আসছে আজকাল। তারা দু’টো তিনটে ধান খেয়ে চলে যায়। আশ্চর্য, এখনও ধানের ছড়া তেমনই আছে, দশ বছর আগে যেমন ছিল। আমরা তো তাদেরই উপকার করি, যেখান থেকে আমরা পালটা উপকার পাই। চড়ুইগুলো আসে। কিন্তু যে সব কবির জন্য লড়াই করেছিল মল্লিকা, তারা ভুলে গিয়েছে ‘সিন্ধুর মেয়েকে’। তারা আর আসে না। তারা বড় হয়ে উড়ে গিয়েছে। কিন্তু নতুন যারা আসছে তারাও উড়ে যাবে। এটাই জীবন।
হাতে গিটার নিয়ে জিন্স পরা একটা মেয়ে এল এক দিন। সিগারেট ধরিয়ে বলল, “আমার নাম হরিণ। আমাকে মল্লিকাদি পাঠিয়েছেন। আপনাকে চা করে দিতে এলাম।” আমি বললাম, “আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন। আমার ফ্ল্যাটটা খুব ছোট। এখানে যদি একটা হরিণ ঘুরে বেড়ায়, সেটা খুব ভাল হবে না।”
আর এক দিন আর একটা মেয়ে এল। সেদিন গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার।
সে আমার মাথায় জলপটি দিল। ওষুধ নিয়ে এল। চুপ করে বসে থাকল। জ্বর কিছুটা কমলে সে বলল, “চলি, ভাল থাকবেন।” আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোমার নাম হরিণ হল না কেন?”
সব ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু ছেলে ম্যানেজ করা সব চেয়ে কঠিন। এলআইসি-র কাগজ, কলের মিস্তিরি, রান্নার লোক কী ভাবে ম্যানেজ করতে হয় সেটার একটা ক্র্যাশ কোর্স করে নিয়েছি মল্লিকার ভাই পার্থর কাছ থেকে। কিন্তু সে বেচারা আমাদের বাপবেটাকে সংসারী করতে না পেরে তিতিবিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছে। আমি রোরোকে বলি, “রাত করিস না।”
সে অবধারিত ভাবে রাত তিনটে পর্যন্ত মুরাকামি পড়বে। এই এক জাপানি লেখক এসেছে। আমার জীবন ফালা ফালা করে ছেড়ে দিল। রোজ সকালে উঠে আমি লাইট নেভাই, কম্পিউটার বন্ধ করি। দশটায় ঘুম থেকে উঠেই দেরি হয়ে গিয়েছে বলে আগের দিন থেকে পরে থাকা প্যান্ট-শার্ট পরে সুপ্রিয়াদির ক্লাস আছে বলে ছুটে বেরিয়ে যায় রোরো। খাবার টেবিলে তার ভাত পড়ে থাকে। মল্লিকা যদি কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখত টেবিলে ভাত পড়ে আছে, আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আবার নৈঋতে ফিরে যেত।
এর মধ্যে এক দিন আমাকে পাওয়া গেল না। সারা দিন আমি নিখোঁজ। রোরো আমাকে বারবার ফোন করেও পেল না। রাত করে আমি যখন বাড়ি এলাম, ও বলল, “কোথায় ছিলে?” আমি বললাম, “একটা মায়ামৃগর সঙ্গে ছিলাম।” ও বলল, “সে আবার কী? মায়ামৃগ মানে?” আমি বললাম, “হরিণ।” পরের দিন আমি রোরোকে পেলাম না। সারা দিন ফোন করে গেলাম। ও ফোন ধরল না। রাত ন’টায় বাবু ফিরলেন। আমি চড় কষাব কি না ভাবছি। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় ছিলিস?” সে বলল, “একটা মায়ামৃগর সঙ্গে।” আমি থ। ও বলল, “কেন বাবা? তোমার যদি একটা মায়ামৃগ থাকতে পারে, আমার একটা হরিণ থাকতে পারে না?”
মল্লিকার মৃত্যুর পর মহৎ মানুষের অনেক ক্ষুদ্রতা আমি দেখেছি। অনেক বিবেকবাবুর পক্ষপাত নামক রোদচশমাকে ভুল করে সম্মান করেছি। গত চার বছরে আমার জীবনে তিনটে মারাত্মক ঘটনা যা আমি আজও মেনে নিতে পারিনি এক মল্লিকা, দুই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তিন ন্যানো। প্রথম দু’জন মানুষ, কিন্তু তৃতীয়টি গাড়ি। আমি চেয়েছিলাম যাদের যেতে হবেই, তারা যায় যাক। কিন্তু ন্যানো থাকুক। ছেলেমেয়েগুলো চাকরি পাক। মল্লিকা চলে গিয়ে বাংলা কবিতার কী ক্ষতি হয়েছে আমি জানি না। কিন্তু আমার আর রোরোর জীবন থেকে একটা আঁচল সরে গিয়েছে। এ বার ২৭ মার্চ মল্লিকার জন্মদিনে সবাই দোল খেলবে। আমি আর রোরো ঘরে বসে থাকব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.