|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
এত ছবি হচ্ছে, অথচ আমায় কেউ ডাকে না |
ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে উত্তেজিত বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ক্ষোভ ও অভিমানের কথা শুনলেন সংযুক্তা বসু |
পত্রিকা: কিছু দিন আগে ফোনে আপনার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, বলেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে ইদানীং আপনার নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়...
বিপ্লব: মনে হয়ই তো। অর্ধেক লোক আমায় চেনে না। চারদিকে কত ছবি হচ্ছে। কিন্তু আমাকে কেউ ডাকে না। ষাট বছরের বুড়োর রোলে কাজ করতে পারি। সেটাও প্রায় পাই না বললেই চলে।
পত্রিকা: এরকম হল কেন? আপনি এখনও বামপন্থী। টলিউডে তৃণমূলের লবি কি এর জন্য দায়ী?
বিপ্লব: না। একেবারেই না। দায়ী আমার কপাল। আমার সিদ্ধান্ত।
পত্রিকা: কোন সিদ্ধান্ত?
বিপ্লব: আমি বাছাই করে চরিত্রে অভিনয় করিনি। দু’তিনদিনের কাজ আছে এমন চরিত্রেও অভিনয় করেছি। সেই জন্যই একটা সময়ের পর আমাকে আর মানুষ মনে রাখেনি।
পত্রিকা: বাছাই করে কাজ করতেন না কেন?
বিপ্লব: পয়সার জন্য। টাকা রোজগার করে সংসার চালানোর দায়ে চুজি হতে পারিনি।
পত্রিকা: কত ছবিতে তো অভিনয় করলেন, তাও অর্থ সমস্যা?
বিপ্লব: সিনেমা করে ক’টাকা রোজগার হত? প্রথম ছবিতে চার দিনের কাজ করে পেয়েছিলাম তিরিশ টাকা। সিনেমায় এখন যেমন টাকা পাওয়া যাচ্ছে, তখন তা পাওয়া যেত না। যাত্রা না করলে আমি নিজস্ব বাড়ি করতে পারতাম না। এখন যাঁরা সিনেমায় প্রতিষ্ঠিত তাঁদের অধিকাংশই যাত্রা করেছেন বলেই বাড়ি করতে পেরেছেন। আমাকেও সাত বছর টানা যাত্রা করতে হয়েছে।
|
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
পত্রিকা: কোন সময়টা আপনার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়?
বিপ্লব: গত বছরটা। গত বছর আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ইন্ডাস্ট্রিতে তো আমার অনেক সুহৃদ। তাঁদের কেউ কেউ বলাবলি করতে লাগলেন যে, “বিপ্লব আর হাঁটাচলা করতে পারবে না। কাজ করতে পারবে না। অসুস্থ।” কী করে জানি না সারা ইন্ডাস্ট্রিতে চাউর হয়েছে আমি খুব অসুস্থ। এটা একেবারেই ভুল। সেই জন্যই নিজেকে আরও বেশি করে অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।
পত্রিকা: হয়তো এই সুহৃদেরা সবাই তৃণমূলের...
বিপ্লব: বললাম না সবটাই কপাল। কোনও রাজনৈতিক চক্রান্তের গন্ধ এর মধ্যে নেই। তৃণমূলে আছেন এমন মানুষজনও আমার খুব বন্ধু।
পত্রিকা: এখন না হয় কাজ কম আসছে। কিন্তু ১৯৭১য়ে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ থেকে ‘আকালের সন্ধানে’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ থেকে ‘দেখা’, অগুনতি ভাল ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাও এত ক্ষোভ?
বিপ্লব: ক্ষোভ নয়। অতৃপ্তি। ভাল কাজের খিদে এখনও আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যাঁরা সত্যিকারের বড় পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তই বলুন বা তরুণ মজুমদার, এঁরা যে কেন আমায় ব্যবহার করলেন না জানি না। এমনকী সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন....তাঁরাও তো আমাকে আর একটু কাজ দিতে পারতেন। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র দশ বছর পর ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’। তার মাঝখানে তো উনি কত ছবি করলেন। আমি একটাতেও নেই। ‘পাতালঘর’ আমার শেষ মনে রাখার মতো ভাল ছবি। তার পর আর নেই। এগুলো আমার অভিমান বা দুঃখ বলতে পারেন। রাগ নয়। অভিযোগও নয়। পরিচালকেরা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাঁদের কাছে আমি আর একটু সুযোগ আশা করেছিলাম।
পত্রিকা: কিন্তু আপনি বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতে তো প্রচুর অভিনয় করেছেন। সেটা তো একটা তৃপ্তির জায়গা।
বিপ্লব: হ্যাঁ। আমার ছবির সংখ্যা আড়াইশো পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটা তো অতীত। এখন ভাল চরিত্র পাচ্ছি কই? এখন যা বয়স হয়েছে তাতে বাবা, কাকা, জ্যাঠা, পিসে এই সব চরিত্র যদি বৈচিত্রময় ভাবে কিংবা একটু সাহসী ভাবে তৈরি হত বাংলা ছবিতে, তো অভিনয় করে সুখ পেতাম। মুম্বইতে সিনিয়রদের জন্য নানা ভাবে চরিত্র তৈরি হয়। এখানে সেটা হচ্ছে না। কিছু দিন আগে ‘খোকাবাবু’ বলে একটা ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। বসে বসে অভিনয়। সংলাপ ছিল না কোনও। সবটাই এক্সপ্রেশন। বেশ ভাল লেগেছিল কাজ করে। অনেকে প্রশংসাও করেছিলেন।
পত্রিকা: তা হলে ভাল কাজ তো করছেন।
বিপ্লব: করছি ঠিকই। রাজ চক্রবর্তীর, রবি কিনাগির ছবিতে কাজ করেছি। বেশ ভাল লেগেছে। আমি পুরস্কারও পেয়েছি বেশ কিছু। তাও মনে হয় কোথায় যেন ফাঁক থেকে গেল। আমি এখনও চাইছি পরিচালকেরা আমায় খাটান। নানা ধরনের চরিত্রে আমায় ভাবুন। প্রাণ ঢেলে কাজ করব।
পত্রিকা: নতুন পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন?
বিপ্লব: হ্যাঁ। কাউকে কাউকে ফোন করেছি। তাঁরা আমার ফোন পেয়ে আপ্লুত ভাব দেখিয়েছেন। কিন্তু কাজ আসেনি। আমার কথা হল আপনারা এতই যখন আপ্লুত কাজে ডাকেন না কেন?
পত্রিকা: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসছি। অনেক সময়ই খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। খলনায়ক হতে কি এখন একঘেয়ে লাগে?
বিপ্লব: বাংলা ছবির খলনায়ক চরিত্রগুলোই এখন বেশ একঘেয়ে। মুম্বইয়ের প্রতিটি নায়ক শাহরুখ খান থেকে নানা পটেকর সবাই খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অক্ষয় খন্না ‘হমরাজ’ ছবিতে যে ভাবে খলনায়কের অভিনয় করেছিলেন তা ভোলার নয়। আমি সেই রকম ধরনের খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে চাই, যার মধ্যে বৈচিত্র আছে। এখন যদি কেউ বলে খলনায়ক সাজতে গেলে মেয়েদের ব্লাউজ টেনে ছিঁড়তে হবে, পারব না।
পত্রিকা: তা হলে খলনায়ক হিসেবে আপনার সেরা পছন্দ নিশ্চয়ই ‘শকুনির পাশা’র শকুনি?
বিপ্লব: হ্যাঁ, অন্যতম সেরা পছন্দ তো বটেই। সেই সময় আমার খলনায়ক ইমেজ মাথায় রেখে ‘শকুনির পাশা’ চরিত্রটা ভেবেছিলাম। নামে শকুনি থাকলেও মহাভারতের নানা চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। দর্শক আপ্লুত হয়েছিল সে নাটক দেখে। এখনও ওই নাটক আমার কাছে সুখস্মৃতি।
পত্রিকা: আর সিনেমা জীবনের সুখস্মৃতি? সেখানে আপনার সেরা সময় বলে কিছু নেই?
বিপ্লব: সে আছে। যখন আমি ৭৭-৭৮য়ে এনটি ওয়ানে একসঙ্গে দুটো ফ্লোরে কাজ করছি। একটায় গোঁফ পরে, একটায় গোঁফ খুলে। তার পর অঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে ‘শত্রু’ করলাম। পর পর বেশ কিছু ছবি হল ওঁর সঙ্গে। সেটাও ভাল সময়।
পত্রিকা: বহুরূপী’তে যখন শম্ভু মিত্রের সঙ্গে নাটক করতেন, সেটাও তো ভাল সময়।
বিপ্লব: অবশ্যই। যা কিছু অভিনয়ের হাতেখড়ি, তা তো ওখানেই হয়েছিল। বহুরূপীতে থাকাকালীনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয়। শম্ভুদা মাঝে মাঝে কিছু চিঠি দিতেন বিলি করার জন্য। সেই সব চিঠি বিলি করতে আমাকে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতেও যেতে হত। তখনই আমি জানতে পারি যে উনি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলে একটি ছবি করছেন সম্পূর্ণ নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আমি সত্যজিৎবাবুর কাছে গিয়ে বলেছিলাম কাজ করতে চাই। উনি প্রথম সুযোগ দিলেন। এর পর ধীরে ধীরে সত্যজিৎবাবু আমার কাছে হয়ে গেলেন ‘মানিকদা’। মানিকদা আর শম্ভুদা, এই দু’জন মানুষকে যদি জীবনে না পেতাম, তা হলে হয়তো অভিনয়ে আসার চেষ্টাই করতাম না। দিনের পর দিন উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে শম্ভুদার অভিনয় দেখেছি। কী অসাধারণ গলার মডুলেশন করতেন উনি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতাম। কত কী তো দেখলাম জীবনে। একবারের কথা মনে পড়ে। বাবুর (সন্দীপ রায়) জ্বর হয়েছে। দেখি, নিবিষ্ট হয়ে মানিকদা ছেলের মাথায় জলপটি দিচ্ছেন।...মানিকদা সব সময় কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু ছেলের অসুখের সময় দেখেছিলাম ওঁর পিতৃস্নেহের দিকটাও।
পত্রিকা: ওঁদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। আবার এখনও ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন। ফারাকটা কী?
বিপ্লব: এখন কিছু কিছু কমার্শিয়াল ছবিতে নাচ, গান, মারদাঙ্গা দেখা যায়। আর এক ধরনের মেনস্ট্রিম ছবি হচ্ছে যার গোত্রে পড়ছে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’য়ের মতো সিনেমা। এই সব ছবি নিশ্চয়ই লোকজনের ভাল লাগছে। কিন্তু সর্বস্তরের দর্শকের ভাল লাগছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। শহর ও গ্রামের সব মানুষের ভাল লাগত এমন ছবি আগে হত, এখন সেটা হচ্ছে না। শহুরে দর্শকের ছবি আর মফস্সলের দর্শকের ছবি ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে।
পত্রিকা: এখনকার পরিচালকেরা যেমন অনীক দত্ত, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মৈনাক ভৌমিকএঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন?
বিপ্লব: হ্যাঁ, সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। কিন্তু তাঁরা তো কেউ কাজ দিচ্ছেন না। আর সৃজিত মুখোপাধ্যায়? ফোন করলে ফোন ধরেন না। মনে হয় পছন্দ করছেন না। আমি তাই আর তাঁকে ফোন করি না। শিবুদের (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) ‘মুক্তধারা’ আমার ভাল লেগেছে। একদিন শিবু ফোন করে বলল, ওর ‘অলীক সুখ’ ছবিতে একটা চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। আমিও এক কথায় সানন্দে রাজি হলাম। তার ঘণ্টা দুয়েক বাদে ফোন করে শিবু বলল, “বিপ্লবদা, আমার এক অ্যাসিসটেন্ট অন্য এক জনকে চরিত্রটার জন্য কথা দিয়ে ফেলেছে।” আমি বললাম, হবে না তা হলে! আর কী করা যাবে! আমার কপাল খারাপ।
পত্রিকা: একটা কথা বলি, ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সময় গুঞ্জন ছিল, শতাব্দী রায় আপনার বিশেষ বন্ধু। শোনা যায়, আপনাদের বন্ধুত্বে চিড় ধরেছে।
বিপ্লব: চিড় ধরেছে বলব না। শতাব্দী ওর মতো থাকার কথা ভাবল। আমিও আমার মতো থাকার কথা ভাবলাম। এখন মাঝে মাঝে ফোনে টুকটাক কথা হয়। কিন্তু ওইটুকুই।
পত্রিকা: এই দূরত্বটা কেন?
বিপ্লব: বলা যেতে পারে রাজনৈতিক কারণে। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হয়ে গিয়েছে বলে।
পত্রিকা: রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা যখন উঠলই, একটা কথা বলি।
বিপ্লব: বলুন।
পত্রিকা: আপনার সমমনোভাবাপন্ন অনেকেই তো বাম জমানার বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করেছিলেন। আপনি সে দলে ছিলেন না। ওই সব অত্যাচার, অবিচার দেখে বামপন্থী হিসেবে আপনার গ্লানিবোধ হয়নি?
বিপ্লব: বাম জমানায় অনেক অন্যায়, অবিচার হয়েছিল বলেই তো সরকার থেকে তাদের বিদায় নিতে হল। সেটার জন্য অবশ্যই আমার খারাপ লেগেছিল। আজও লাগে। কী হত প্রতিবাদ করে? ৩৪ বছর ধরে যে অবক্ষয় হয়েছে তা প্রতিবাদে দূর হত না। দরকার ছিল সংশোধন। সেই সংশোধনের জন্য অনেক সময় দরকার ছিল। ক্ষণিকের প্রতিবাদে কিছু হত না।
|
|
|
|
|
|