ব্যাগ গুছিয়ে...
রঙিন দ্বীপান্তর
পুব আকাশে রঙিন আলোকসম্পাত। আন্দামানে ভোর হচ্ছে। রঙ্গত জেটিতে দাঁড়িয়ে আগ্রহভরে তাই দেখছি। দূর থেকে ভেসে আসা ললিত রাগ ও সূর্য ওঠার এই যে কাকতালীয় সমাপতন তা আশ্চর্যজনক হলেও চিত্তরঞ্জক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আন্দামান ভ্রমণে এসে প্রথমে পোর্টব্লেয়ার ও তার আশপাশের দ্রষ্টব্য দেখে নিয়েছি। তার পরে মধ্য ও উত্তর আন্দামানের জারোয়া রিজার্ভ, রঙ্গত, মায়াবন্দর ও ডিগলিপুর ঘুরে রঙ্গতের হোটেলে রাত্রিবাস করে পর দিন ভোরেই বেরিয়ে পড়েছি আন্দামানের আর এক উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হ্যাভলক দ্বীপের উদ্দেশে। রঙ্গত জেটি থেকে রবিবারের এই একটাই জাহাজ হ্যাভলক পৌঁছয় লং আইল্যান্ড ও স্টেট আইল্যান্ড হয়ে। একটু ঘুরপথে হলেও ভালই, তাড়া তো নেই। জাহাজ ছাড়ল সওয়া ৬টা নাগাদ। আপার ডেকে দাঁড়িয়ে দেখছি তীব্র নীলরঙা সমুদ্রের অপূর্ব রূপ। উড়ুক্কু মাছের দল জল থেকে উড়ছে আবার স্বল্পমেয়াদি উড়ানের পর ফের জলে পড়ছে। এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতেই এক সময় চলে গেলাম ক্যাপ্টেনের কেবিনে। সেখান থেকে সমুদ্রযাত্রার রূপ যেন আরও চিত্তাকর্ষক।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম লং আইল্যান্ডে। জেটিতে দেশি-বিদেশি যাত্রীর ভিড়। লং আইল্যান্ড দৈর্ঘে অন্তত ৯-১০ কিলোমিটার তো হবেই। যাত্রীদের নামা-ওঠার পর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ছাড়ল জাহাজ। থামল সটান স্ট্রেট আইল্যান্ডে এসে। সকাল ৯টা নাগাদ। তবে জেটিতে নয়, জলে। এখনে কোনও জেটিই নেই। এই দ্বীপটি লং আইল্যান্ডের মতো অত বড় নয়। দ্বীপে গ্রেট আন্দামানি আদিবাসীদের বসবাস। নিগ্রোসদৃশ এ রকমই এক আদিবাসী এল জাহাজের কাছে। আন্দামান পুলিশের বোটে চড়ে। শুনলাম তেল, ধূপ ইত্যাদি নিতে তার আগমন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে-সব না পাওয়ায় কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার আবার সেই বোটে চেপেই প্রত্যাবর্তন।
এই সব বিচিত্র দৃশ্য দেখতে দেখতেই হ্যাভলক আইল্যান্ড পৌঁছলাম সকাল সওয়া ১০টা নাগাদ। হ্যাভলক জেটি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সরকারি আবাস ডলফিন বিচ রিসর্টে পৌঁছে গেলাম তাড়াতাড়িই। পুরো হ্যাভলক দ্বীপটির পরিধি ১১৩ বর্গ কিলোমিটার। গ্রেট আন্দামানের পুব দিকের এই দ্বীপটির নামকরণ হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন আন্দামানের তৎকালীন জেনারেল হেনরি হ্যাভলকের নামে। পোর্টব্লেয়ারের ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পুবের এই দ্বীপটি এই মুহূর্তে বোধহয় আন্দামানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য। হোটেলে আসার পথে পড়ল গোবিন্দনগর। এটাই বাঙালি অধ্যুষিত হ্যাভলকের সবচেয়ে জমজমাট এলাকা। বাজার, দোকান, ইন্টারনেট কাফে, এটিএম, রেস্তোরাঁ কী নেই? প্রচুর বিদেশি পর্যটকের ভিড় দেখলাম এই জায়গাটায়। বিদেশিদের খুবই প্রিয় গন্তব্য এই হ্যাভলক দ্বীপ। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট পাহাড়ি টিলা দেখতে পাচ্ছি গভীর জঙ্গলে ঢাকা। নারকেল, তাল, জংলি মহুয়া ও অন্যান্য গাছে পরিপূর্ণ সে সব জঙ্গল। গাড়ি চলার রাস্তাও তাল মিলিয়ে কোথাও চড়াই তো কোথাও উতরাই।
রিসর্টের সামনে থেকেই সমুদ্রের দৃশ্য সুন্দর দেখা যায়। অনেকটা বড় এলাকা নিয়ে এই রিসর্ট চত্বর। ছড়ানো ছেটানো কটেজগুলির ফাঁকে ফাঁকে অজস্র গাছপালা পুরো পরিবেশটাকেই একট্য অন্য মাত্রা দিয়েছে। একদম পাশেই বিজয়নগর বিচ। সকালের দিকে যখন গেলাম হাঁটতে হাঁটতে সে দিকে, তখন দেখি অনেকটা দূরে সমুদ্র। দীর্ঘ সৈকতে তখন কোথাও পাথর, কোথাও বা মৃত প্রবালের অবস্থান। তবে চন্দ্রালোকিত রাতে যখন জোয়ার এল, তখন সেই সব ‘কলঙ্ক’ মুছে ফেলে নীল সমুদ্র যেন সত্যিই হয়ে উঠল ‘নীলকণ্ঠ’। এমনকী জলের ঝাপটা এসে লাগল রিসটের্র ফেন্সিং-এও।
দুপুরের খাওয়া সেরে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম গোবিন্দনগর সৈকতের উদ্দেশে। দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। তীরে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল হয়ে রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। দেখলাম সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা এক মাঝবয়সী সাহেব নিবিষ্ট মনে সেই সব গাছের গুঁড়িতে আটকে থাকা প্লাস্টিকের বোতল, ক্যারি ব্যাগ, অন্যান্য নোংরা জিনিস খুরপি দিয়ে সাফ করছেন। পরিবেশ বাঁচাতে এ-দেশের কিছু অবিবেচক পর্যটকের ফেলে দেওয়া নোংরা পরিষ্কার করছেন এক বিদেশি! এক অদ্ভুত লজ্জায় আক্রান্ত হলাম।
দিনের শেষ গন্তব্য কালাপাত্থর সৈকত। খুব দূরে নয় গোবিন্দনগর সৈকত থেকে। নির্জনতার আবহে সৌন্দর্যের অবস্থান এখানে। সত্যিই ভারী সুন্দর সৈকতটি। সৈকতের শুরুতেই দুটো বিশাল কালো পাথরের নামেই সৈকতের এই নামকরণ। জলের রঙেও এখানে দারুণ চমক। খুব কাছে সবুজ, একটু দূরে ফিরোজা, আরও দূরে কালচে তীব্র নীল। জলে মাছ ধরার কিছু নৌকো ভাসছে ইতিউতি। সব মিলিয়ে ভারী চমৎকার এক দৃশ্যসজ্জা দেখে মন ভরে গেল।
প্রকৃতির আলো মিলিয়ে যেতেই সোজা গোবিন্দনগর বাজার। গরম তেলেভাজা থেকে শুরু করে কলা, পাকা পেঁপে আর কিং কোকোনাট চমকপ্রদ কম্বিনেশনে বাদ গেল না কিছুই। আন্দামান ভ্রমণে এসে সামুদ্রিক মাছ খাওয়াটা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি এই সব সুস্বাদু ফলের স্বাদ নেওয়াটা! কেননা, আন্দামানের মাটির গুণেই সে স্বাদ বাস্তবিকই অতুলনীয়।পর দিন ভোরে হ্যাভলক জেটি থেকে স্পিডবোট ভাড়া করে রওনা দিলাম এলিফ্যান্টা দ্বীপের দিকে। এখন আর হাতি দেখা যায় না ঠিকই, তবে কোনও এক সময়ে নাকি হাতি ছিল এখানে, তাই এই নাম। কিন্তু সেই ‘হাতি দ্বীপ’ দেখতে গিয়ে বুকের ছাতি চুপসে যাবে কে জানত? ১৪-১৫ বছরের একটি বাচ্চা চালাচ্ছে সেই স্পিডবোড, যার গতি যেন উল্কাসদৃশ। এই জায়গায় ঢেউ এতটাই বেশি যে, স্পিডবোট সেই হাজারো ঢেউয়ের ক্রমাগত ধাক্কায় লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলেছে। অনেকটা যেন ‘ব্যাং-বাজি’র মতো, যেটা কখনও জল ছোঁয়, কখনও ছোঁয় না। ভারসাম্যের বিন্দুমাত্র হেরফের হলেই, সমুদ্রে পতন যে অবশ্যম্ভাবী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লাইফ জ্যাকেট থাকলেও বিপদের যথেষ্ট আশঙ্কা তাই থাকছেই। হৃৎকম্প-জাগানো দশ মিনিটের এই ভয়ঙ্কর যাত্রার সমাপ্তি ঘটল মনোমুগ্ধকর এক ছোট্ট দ্বীপে এসে। জলের রং মোহিত করে দিল পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। দেখলাম প্রচুর পর্যটক এসেছেন হ্যাভলক থেকে, যাঁরা দেদার সার্ফিং, ওয়াটার-স্কুটার রাইড, স্কুবা-ডাইভিং, গ্লাস-বটম বোট রাইড প্রভৃতি সমুদ্রক্রীড়ায় ব্যস্ত। ঘুরে নিলাম ছোট্ট দ্বীপের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।
হ্যাভলক জেটি থেকে গাড়িতে চেপে এ বার সোজা রাধানগর সৈকত। হ্যাভলকের সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈকত এটিই। ২০০৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সৈকতের শিরোপা পেয়েছিল এটি। অনেকটা আধফালি চাঁদের আকৃতি নিয়ে বেঁকে গিয়েছে রুপোলি বালির এই সৈকত। সবুজ গাছপালায় ভর্তি পাহাড়ি টিলার পাশ থেকেই যেন পান্না-সবুজ জল ঢুকে এসেছে ভিতরে। আন্দামানের সব সৈকতই স্নানের জন্য নিরাপদ নয়। তবে রাধানগর সৈকতে স্নান করাটা আনন্দদায়ক ও নিরাপদ। জলে বেশ ঢেউও আছে এখানে।
ধীরে ধীরে দিনের আলো মলিন হল। রক্তিম দিনমণি রাজপাট গুটিয়ে এক সময়ে টুপ করে ঢলে পড়ল সাগরজলে। মায়াময় সেই সৈকতে এক অসাধারণ সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে রইল পর্যটকের দল।
পর দিন হ্যাভলক জেটি থেকে পোর্টব্লেয়ারগামী জাহাজ ছাড়ল সকাল সাড়ে ৯টায়। আপার ডেকে দাঁড়িয়ে দেখছি সবুজে মোড়া হ্যাভলকের তটভূমি ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। তার পর চার ধারে শুধুই নীল জলরাশি!
এ বার মন খারাপের পালা। ছুটি শেষ। রঙিন দ্বীপান্তরের এই যে অনাবিল মাধুরী মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত হয়ে রইল, তা বোধহয় চিরকালীন। ভাবনায় ছেদ পড়ল কলকাতাগামী বিমানের পাইলটের ঘোষণায় ‘উই আর জাস্ট ল্যান্ডিং অন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস এয়ারপোর্ট, কলকাতা।’
বৃত্ত সম্পূর্ণ হল!

কী ভাবে যাবেন
পোর্টব্লেয়ার থেকে সপ্তাহে রোজই জাহাজ ছাড়ে হ্যাভলকের উদ্দেশে। সময় লাগে ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট।
বিলাসবহুল ক্যাটামারানও যায় হ্যাভলক। সময় লাগে প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা। এ ছাড়া আছে
সি প্লেন। সময় লাগে মিনিট কুড়ি। আবার রঙ্গত থেকে ঘণ্টা চারেকের সমুদ্রযাত্রায়
(মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি) পৌঁছনো যায় হ্যাভলক দ্বীপে।
কোথায় থাকবেন
সরকারি হোটেল ‘ডলফিন বিচ রিসর্ট’ ছাড়াও প্রচুর বেসরকারি হোটেল ও
টেন্টের ব্যবস্থা আছে হ্যাভলক দ্বীপে। থাকা যেতে পারে রাধানগর সৈকতেও।

রঙিন দ্বীপান্তর




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.