|
|
|
|
|
|
|
হাঁড়ির খবর |
গোলক রহস্য
ঋজু বসু |
|
উত্তর কলকাতার বনেদিঘরের সেই ‘জ্যাঠাইমা’র গোপন খাতাটার জন্য এখনও হা-হুতাশ করেন পরিবারের পোড়খাওয়া গিন্নিরা অনেকেই।
রাঁধাবাড়া থেকে ঘরকন্নার চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া ওই মহিলার ঠোঁটের ডগায় থাকত যে কোনও রান্নার প্রণালী থেকে আচার-অনুষ্ঠানের ফর্দের খুঁটিনাটি। আবার ভারী গোপন জায়গায় লুকনো একটি খাতায় টুকেও রাখতেন সব তুকতাক। কাউকে শেখানোর বেলায় কিন্তু একটি নিয়ম মেনে চলতেন জ্যাঠাইমা। পুরোটা বললেও, মাঝের একটা ‘স্টেপ’ উহ্য থাকত। ফলে, জ্যাঠাইমার কাছে শিখে শুক্তো রাঁধলেও, রান্নাটা কখনওই হুবহু জ্যাঠাইমার মতো হতো না। জ্যাঠাইমা এখন সগ্গে! দুঃখের কথা, সেই খাতাটিও পদিপিসির বর্মিবাক্সের মতো উবে গিয়েছে।
রসগোল্লা বিশারদ চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্ণধার নিতাইচন্দ্র ঘোষ তেমনটা হতে দিতে চান না। কালের নিয়মে হয়তো বাংলার মিষ্টির ঐতিহ্য আগাগোড়াই পাল্টে অন্য কিছু ঠাঁই করে নেবে। তবু পুরনোটাও কোথাও থাকুক, সেইটে তাঁর ইচ্ছে। চিত্তরঞ্জন সৃষ্ট নতুন ওয়েবসাইট রসগোল্লাডটকম ‘www.rasogolla.com’-এর জন্মের নেপথ্যে এটাই গল্প। |
|
ইন্টারনেট এ কালে সব-বিষয়ে সিধু জ্যাঠা। রসগোল্লা, চমচম, জিলিপি, শোনপাপড়ি সব কিছুর ভিডিও উপস্থাপনা অবধি মিলবে ইউ টিউবে। তার উপরে দেশে-বিদেশে রন্ধনপটিয়সীদের গুচ্ছ-গুচ্ছ ব্লগ, ফেসবুকে খাদ্যরসিক রান্না-উৎসাহীদের কমিউনিটি, ‘রান্নাবাটি’। বিশেষ করে নকুড়-যাদব-ভীম নাগ বিহীন জীবনে প্রবাসী বাঙালিরা আজকাল ঘরে-ঘরে ফাটাফাটি মিষ্টি গড়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। রসগোল্লা ডট কমের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কৃষ্ণা বসু বলছিলেনও সে-কথা। নেতাজি সুভাষের বাড়ির বউ তথা শিক্ষাব্রতী কৃষ্ণাও বহু বছর আগে বস্টনে তাঁদের প্রবাস-জীবনে কারও বাড়িতে গেলেই বাঙালিয়ানার নির্ভেজাল স্মারক হোমমেড রসগোল্লা নিয়ে যেতেন। সেটা না কী লোকের রীতিমতো মনে ধরত।
তবু চিত্তরঞ্জনের নিতাইচন্দ্রই যে কোনও রসগোল্লাকে রসগোল্লা বলে মানতে রাজি নন। বাস্তবিক, বাড়িতে মায়ের হাতের রসগোল্লাকে সুসন্তানমাত্রেই বাহবা দেবেন, মুখে দিলে সেটা হয়তো ভালই লাগবে। কিন্তু বিষয়টা রসবড়া না রসগোল্লা তা নিয়ে ধন্দ থাকতে পারে। চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-প্রকরণের তাই আলাদা মহিমা, মানতেই হবে।
রসগোল্লার ওয়েবসাইট খুলে পুরোটা আশা এখনই পূর্ণ হচ্ছে বলা যাচ্ছে না। কানাডার কিউবেকের হেরিটেজ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক পূর্ণা চৌধুরী নেট-পাড়ায় নতুন কোনও রান্নার খবরে সারাক্ষণ তক্কে-তক্কে থাকেন। তাঁরও আক্ষেপ, রসগোল্লা বানাতে কী কী করা হয় বলে গেলেও, ছানা কাটানোর খুঁটিনাটি থেকে রসগোল্লা ফোটানোর টুকিটাকি চিত্তরঞ্জন পুরোটা খোলসা করেনি। নিতাইবাবুও মানছেন, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঘরে-ঘরে রসগোল্লা-স্রষ্টা তৈরি হয়ে যাবে, এটা তাঁদের লক্ষ্য নয়। তবে মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা-সৃষ্টির একটা ইতিবৃত্ত নথিবদ্ধ করা গিয়েছে। |
|
তাতেও অবশ্য কিছু বিতর্ক থাকছে। লোকমুখে রসগোল্লার ‘কলম্বাস’ নবীন দাশের গপ্পো কিন্তু ওয়েবসাইটে থাকতে পারত। রসগোল্লা-বিষয়ক ওয়েবসাইটকে স্বাগত জানিয়েও কথাটা বলছেন নবীন দাশের উত্তরসূরি তথা কে সি দাশ প্রতিষ্ঠানের কর্তা ধীমান দাশ। রসগোল্লার স্বত্ত্ব নিয়ে বাংলা ও ওড়িশার আকচা-আকচির জবাবও ওয়েবসাইটে মিললে ভাল হত।
বাস্তবিক, রসগোল্লার ঘরানাতেও তো বাংলার মধ্যেই বেশ ক’টি ভাগ রয়েছে। মফস্সলের ঈষৎ কড়াপাক রসগোল্লা ছাড়া অন্য কিছ কারও কারও মুখে রোচে না। চিত্তরঞ্জনের ফিকে মিষ্টি মিহি রসগোল্লা মুখে দিলে প্রায় গলে যাবে। সুইট টুথবিহীন ঘোর মিষ্টি-বিরোধীকেও দেখা গিয়েছে, ওই রসগোল্লা টপাটপ মুখে পুরছেন। চিন্তামণি কর একদা এই রসগোল্লা খেয়েই বলেছিলেন, এ হল অতৃপ্ত কামনার মতো। একটায় তৃপ্তি হয় না। কে সি দাশের দোকানে নবীন দাশ কৃত স্পঞ্জ রসগোল্লা আবার মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী। স্পঞ্জ নিংড়োনোর মতো রসটুকু শুষে নিলেও কিছুটা ছানাবশেষ মুখে থাকে। আ-স্তে আ-স্তে কিন্তু প্রগাঢ় ভাবে জিভে-দাঁতে তাকে শেষ চুমুটা খাওয়ার মধ্যেই অনেকের রসগোল্লা চাখার জমপেশ সুখ।
ওয়েবসাইটে উঠে এসেছে, দুর্গাপুরে নিজেদের খামারে গরুর আদর-যত্ন করে দুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে ল্যাবরেটরিতে মিষ্টির গুণমান যাচাই অবধি চিত্তরঞ্জনের মিষ্টি-চর্চার কথা। তবে নিতাইবাবুর দাবি, এ স্রেফ নিজের ব্র্যান্ডের ঢাক পেটানো নয়! মিষ্টির ইতিহাসটাকে তুলে ধরাই লক্ষ্য। ওয়েবসাইটের গেস্টবুকে যে কোনও মিষ্টি-রসিক লিখতে পারেন। বিভিন্ন মিষ্টি-স্রষ্টারাও স্বাগত। |
|
বলরাম, ফেলু মোদক, কে সি দাশ, মাখনলালের মতো বাঙালি মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানেরও নিজস্ব ওযেবসাইট আছে। ফেসবুক কমিউনিটিতে রয়েছে নকুড়। তবু ওয়েবসাইটের পরিসর যে মিষ্টি-চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে, সেই ভাবনার এটাই গোড়াপত্তন।
তবে এই মুহূর্তে কাজটা সবে শুরু হয়েছে, বলা যায়। ওয়েবসাইট উদ্বোধনে এসে শঙ্কর বলছিলেন, মুজতবা আলি-র কথা। যিনি বলেছিলেন, কাজটা নেহাতই সোজা কথা নয়! বাঙালির মিষ্টি-চর্চার ইতিহাস লিখতে ১০টা প্রকাণ্ড খণ্ড লেগে যাবে। তার এই ওয়েবসাইট-অধ্যায়ের প্রধান চরিত্র রসগোল্লা। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র থেকে কলকাতা-বিষয়ক গবেষক হরিপদ ভৌমিকেরা মেনে নিচ্ছেন, মতিচুর, গজা, জিলিপিদের তুলনায় এই ‘গোল্লা’ বয়সে নেহাতই ছোকরা।
বাড়ির সব থেকে আদরের ছোট ছেলেটির নামেই নেটের দুনিয়ায় বাঙালি-মিষ্টির এই জয়যাত্রা। |
|
|
|
|
|