কনফেডারেশন কাপ আর মাত্র তিন মাস দূরে। বিশ্বকাপ তার ঠিক এক বছর পর। দু’টোই ব্রাজিলে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে ইতালির বিরুদ্ধে যে ব্রাজিলকে খেলতে দেখলাম, পরিষ্কার বলছি, ঘরের মাঠেও তাদের কাপ জেতা দুষ্কর।
ডিফেন্স নড়বড়ে। মাঝমাঠে বল হোল্ড করে আক্রমণ তৈরির লোক নেই। স্কিলফুল ফরোয়ার্ড নেই। গোলকিপার নিজের দোষে গোল হজম করছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেই ব্রাজিলিয়ান টাচ-ই খুব কম দেখতে পেলাম। ব্রাজিল বলেই স্কিলের কিছু ছটা তার মধ্যেও অবশ্য ছিল। বিশেষ করে ডান পায়ের চেটো দিয়ে চকিতে মারা অস্কারের দ্বিতীয় গোলের প্লেসিংটা। বুফোঁর মতো নামজাদা গোলকিপারও অসহায়ের মতো গোল খেতে বাধ্য হল।
কিন্তু তা ছাড়া? আজকের আপাদমস্তক মার্কেটিংয়ের যুগেও জেনিভার এই ম্যাচে ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সির পিছনে ফুটবলারদের সামান্য নামটুকু না-লেখা থাকা পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের যেমন পেশাদারিত্বের দৈন্য প্রকাশ করছিল। তেমনই অভাবনীয় দীনতা যেন তাদের ফুটবলেও! প্রথমার্ধে তবু কিছুটা খেলেছে ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে সেটুকুও না। তা সত্ত্বেও হাফটাইমে স্কোলারির দল ড্রেসিংরুমে ফেরে ২-০ এগিয়ে থেকে। ব্রাজিলকে ২০০২-এ শেষ বার বিশ্বকাপ জেতানো কোচ স্কোলারি-কে ‘বিগ ফিল’ নামে ডাকা হয়, ড্রেসিংরুমে ফুটবলারদের উপর কর্তৃত্বের জন্য। কিন্তু গত রাতে ড্রেসিংরুম থেকে বিরতির পর মাঠে ফেরা জুলিও সিজার, দানি আলভেস, হাল্ক, নেইমার, ফ্রেড, কিংবা বদলি হিসেবে নামা কাকা, মার্সেলোরা ইতালির প্রতিটা বলের জন্য প্রাণপণ তাড়া আর হার না মানা মনোভাবের কাছে কেমন যেন নতজানু হয়ে থাকল! ব্রাজিলের থেকে যেটা দেখাটা সত্যিই অকল্পনীয়। এই ব্রাজিলকে দেখতে কেউ রাত জাগবে বলে আমার সন্দেহ আছে। ইংল্যান্ডের, কাছে ওরা ২৩ বছর পর সম্প্রতি হেরেছে। কলম্বিয়ার সঙ্গে ড্র করেছে। অন্য দিকে, ইতালি আগের ম্যাচেও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে এক গোলে পিছিয়ে থেকে ১-১ করেছিল। |
ইতালির প্রায় পুরো জাতীয় দলটা তাদের দেশজ লিগে খেলা ফুটবলারে ভরা। কিন্তু বুঁফো, বনুচি, মাজ্জিও, পির্লো, মন্টোলিভো, বালোতেলিরা সবাই নিজেদের ক্লাবের অন্যতম সেরা প্লেয়ার। সেখানে বার্সেলোনায় আলভেস, চেলসির অস্কার, রিয়াল মাদ্রিদের মার্সেলো, জেনিট-এ হাল্ক বাদে ব্রাজিল টিমে সে ভাবে কেউ ইউরোপের বিখ্যাত ক্লাবগুলোর প্রথম দলের প্লেয়ার নয়। নেইমারকে স্যান্টোসে যতই পেলের উত্তরসূরি পর্যন্ত ভেবে ফেলা হোক, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যান ইউয়ের মতো ইউরোপের নামী ক্লাবে সফল হওয়ার মতো মশলা নেইমারের খেলায় আছে বলে অন্তত ইতালির বিরুদ্ধে পারফরম্যান্সে বোঝা গেল না। এর চেয়ে বরং পাতো ভাল ছিল। ব্রাজিল দলে এখনই রোনাল্ডিনহোকে দরকার। কাকাকেও প্রথম থেকে খেলানো উচিত। হয়তো ফ্রেন্ডলি ম্যাচ বলে স্কোলারি পরীক্ষানিরীক্ষা বেশি করেছেন।
কিন্তু মিলিত ভাবে যারা ন’বার বিশ্বকাপ জিতেছে (বিশ্বকাপ জেতার কৃতিত্ব ব্রাজিলের পাঁচ আর ইতালির চার বার), সেই দু’দেশের মধ্যে প্রদর্শনী ম্যাচের তাৎপর্যও আলাদা। প্রান্দেলি কোচ হওয়ার পর ইউরো কাপ থেকেই দেখা যাচ্ছে, কাতানেচিও ডিফেন্সের জনক ইতালির খেলাতেও আক্রমণাত্মক স্টাইল। অনেক বেশি উইংয়ের ব্যবহার। সাইড ব্যাকরা মুহুর্মুহু ওভারল্যাপে যাচ্ছে। সঙ্গে ইতালির বরাবরের সেটপিস থেকে গোল করার দক্ষতা তো আছেই। সে ভাবেই কর্নার থেকে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও দি’রোসির গোল। আর বালোতেলি ২-২ করার শটটা খুব ভাল নিয়েছে বলেও বলব, সিজার অহেতুক গোল ছেড়ে এগিয়ে না থাকলে ওই শটও বাঁচানো যেত। ইতালি জিতেও যেত যদি বালোতেলি ফাঁকা বল পেয়েও গোলকিপারের হাতে না মারত।
তবে ব্রাজিল-ইতালি মহালড়াইও ক্লাব ফুটবলের মেগা ম্যাচের রোমাঞ্চ, গতি, স্কিল, স্ট্র্যাটেজি-ট্যাকটিক্সের ঝনঝনানি উৎপন্ন করতে ব্যর্থ। আসলে বার্সা-রিয়াল-বায়ার্ন-ম্যান ইউ-পিএসজি-র মতো ক্লাবে সব দেশের বাছাই করা তারকা ফুটবলারদের ভিড়। পর্দার আড়ালে ধুরন্ধর কোচেদের মগজাস্ত্র। স্পেনের মতো অগুনতি স্কিলফুল ফুটবলারের দেশ ছাড়া অন্য দেশের জাতীয় দলে ভাল প্লেয়ারের পাশাপাশি সাধারণ মানের ফুটবলারও একাধিক। ফলে ক্লাব ফুটবলের উঁচু স্ট্যান্ডার্ড, অফুরন্ত উত্তেজনা অতি ধীরে হলেও হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় দলের লড়াই থেকে।
কে বলতে পারে, এক দিন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জৌলুসের কাছে বিশ্বকাপকেও ম্লান দেখাবে না? |