কারখানা নির্মাণ বন্ধ ভদ্রেশ্বরে
শাসক দলের সিন্ডিকেটকে বোঝাতে গিয়ে বদলি ওসি
নানা মঞ্চ থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়তে যখন ডাক দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন তাঁরই দলের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বন্ধ হয়ে গেল ভদ্রেশ্বরে প্রস্তাবিত একটি প্লাইউড কারখানা নির্মাণের প্রাথমিক কাজ। মধ্যস্থতা করতে গিয়েছিলেন ওসি দেবনাথ সাধুখাঁ। কিন্তু তার পরে যা ঘটল, তা একমাত্র সিনেমায় দেখা যায়। অভিযোগ, মধ্যস্থতা করতে গিয়ে থানায় বসেই ওসিকে শুনতে হয় তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীর হুমকি। এবং বদলিও হতে হয় কয়েক দিনের মধ্যেই। এই অবস্থায় কারখানার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে মালিকপক্ষ। তার থেকেও বড় কথা, ওই থানার দায়িত্ব নিতেই এখন দ্বিধাগ্রস্ত অনেক পুলিশ অফিসার। পুলিশ সূত্রেই এ কথা জানানো হয়েছে।
ঘটনা নিয়ে পুলিশকর্তারা মুখ খুলতে চাননি। জেলা তৃণমূল নেতৃত্বও সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে,
বদলি হওয়া ওসি
দেবনাথ সাধুখাঁ
তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দলের কারা ওখানে সমস্যা করছে, তা পুলিশ সুপারকে জানাক ওই শিল্প সংস্থা। নিশ্চয়ই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কী ঘটেছে ভদ্রেশ্বরে?
শ্বেতপুর মোড়ে একটি সরকারি পার্ক লাগোয়া প্রায় ৪৪ বিঘা জমি কিনেছেন কলকাতার এক শিল্পপতি, প্লাইউড তৈরির কারখানা করবেন বলে। জমিটিতে মাটি ফেলে উঁচু করতে এবং পাঁচিল দিয়ে ঘিরতে একটি নির্মাণকারী সংস্থাকে বরাতও দেন তিনি। কিন্তু গত বছর ডিসেম্বরে কাজ শুরুর দিনই দেখা দেয় বিপত্তি।
এসডিপিও (চন্দননগর) সৈকত ঘোষের কাছে দায়ের করা অভিযোগে ওই নির্মাণকারী সংস্থার পক্ষে জানানো হয়, কাজ শুরু করার দিনই ‘ইউনিক’ নামে ওই সিন্ডিকেটের লোকজন এসে তা বন্ধ করে দেয়। এ নিয়ে ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে পরে তাঁরা আলোচনা করতে চেয়েও ব্যর্থ হন। ওই অভিযোগে বলা হয়, বহু টাকার ইমারতি সরঞ্জাম নষ্ট হচ্ছে। শ্রমিকদেরও বসিয়ে মজুরি দিতে হচ্ছে।
ওই সিন্ডিকেটের অন্যতম মাথা হলেন তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী তুষার ঘোষ। সিন্ডিকেট সদস্যদের বেশির ভাগই তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। ওই নির্মাণকারী সংস্থার কর্ণধার সমীর বসু বলেন, “কাজের প্রথম দিনই তুষারবাবুরা এসে দাবি করেন, ওঁরাই পুরো কাজ করবেন। আমরা আপত্তি করায় ওঁরা কাজে বাধা দিচ্ছিলেন। ক্ষতি হচ্ছে দেখে ওঁদের সঙ্গে আলোচনাও করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গোড়ায় দিকে এক বার ছাড়া ওঁরা আর সাড়া দেননি।” কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তুষারবাবু। তাঁর দাবি, “আমি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নই। বরং সমস্যাটা আলোচনা করে মেটানোর চেষ্টা করেছিলাম। তৃণমূল নেতাদের একাংশই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।”
সমীরবাবুরা প্রথমে জেলার তৃণমূল নেতাদের কাছে যান। তাঁরাই তাঁকে পুলিশের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এর পর এসডিপিও-র কাছে তাঁরা অভিযোগ দায়ের করেন। এসডিপিও-র নির্দেশে ভদ্রেশ্বর থানার তৎকালীন ওসি দেবনাথবাবু সমস্যা মেটানোর জন্য তুষারবাবুকে ডেকে পাঠান। অভিযোগ, তুষারবাবু থানায় গিয়ে ওসিকে হুমকি দেন এবং পরে শ্বেতপুর ফাঁড়ির এক পুলিশকর্মীকে হুমকি দেন, তাঁকে ডেকে পাঠানোর জন্য ওসিকে বদলি করে দেওয়া হবে।
অনেকে বলছেন, এমন ঘটনা সচরাচর সিনেমাতেই দেখা যায়। সেখানে ভিলেনের মুখে প্রায়শই এ ধরনের হুমকি শোনা যায়, তা সে তিন দশক আগের বাংলা ছবি ‘শত্রু’-ই হোক বা হাল আমলের হিন্দি ছবি ‘সিংহম’। খলনায়কের অঙ্গুলিহেলনে কোথাও ওসি বদলি হন, কোথাও তাঁর ত্রাতা হয়ে ওঠেন জনগণ।
ভদ্রেশ্বরে বাস্তবে কী ঘটল? ওই হুমকি যে ফাঁপা নয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায় দিন কুড়ির মধ্যে। বদলি হয়ে যান দেবনাথবাবু। পুলিশের একটি মহল জানাচ্ছে, ওসিকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরে চুপ করে বসে থাকেননি তুষারবাবু। অভিযোগ, তিনি দলের উপরমহলের কাছে নালিশ করেন ওসির নামে। দাবি করেন, দেবনাথবাবুকে এখনই বদলি করা হোক। পুলিশের ওই সূত্র আরও জানাচ্ছে, সেই মতো পুলিশের শীর্ষস্তরের কাছে নির্দেশ যায়। বদলি হতে হয় দেবনাথবাবুকে।
দেবনাথবাবু ওসি হিসেবে ভদ্রেশ্বর থানায় যোগ দিয়েছিলেন চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ১৭ মার্চ তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয় জেলা এনফোর্সমেন্ট বিভাগে। এ নিয়ে দেবনাথবাবু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “পুলিশ অফিসারদের বদলি পুরোপুরি বিভাগীয় বিষয়। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে কোনও কথা বলব না।”

এই জমিতেই কারখানা হওয়ার কথা। তার মধ্যে লাগানো সিন্ডিকেটের বোর্ড।—নিজস্ব চিত্র
তৃণমূলের সিন্ডিকেটের ‘দৌরাত্ম্য’ নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পুলিশের এক শীর্ষস্থানীয় কর্তা বলেন, “ওসি বদলি নিয়ে জেলাস্তরেই সিদ্ধান্ত হয়। এই নিয়ে মহাকরণে কোনও অভিযোগ আসেনি।” অন্য দিকে, তুষারবাবু হুমকির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “ওসি ডাকায় মার্চের গোড়ায় থানায় আলোচনার জন্য গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু আমি কেন হুমকি দিতে যাব?”
তুষারবাবু দায় এড়িয়ে গেলেও, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যেই যে প্লাইউড কারখানার কাজ বন্ধ, তা জেলা পুলিশের একাংশ স্পষ্টই স্বীকার করছেন। মমতা একাধিকবার দলীয় নেতা-কর্মীদের সিন্ডিকেট ব্যবসায় যুক্ত থাকতে নিষেধ করেছেন।
কারণ, কলকাতা সংলগ্ন রাজারহাটে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বড় মাপের গোলমাল তো বটেই, প্রাণহানির ঘটনা পর্যন্ত ঘটে গিয়েছে।
কিন্তু তৃণমূল কর্মীরা না শোনেন ধর্মের কাহিনি! তাই নানা ঘটনায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। ভদ্রেশ্বরের ঘটনা তাতে নতুন সংযোজন। এলাকার অনেকেই এখন বলছেন, “সিন্ডিকেটের লোকজন কত শক্তিশালী সেটা প্রমাণ হয়ে গেল ওসি বদলের ঘটনায়।”
তৃণমূল জেলা নেতৃত্ব অবশ্য এখন কঠোর অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। দলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, “দলের কঠোর নির্দেশ রয়েছে, কোথাও কোনও সিন্ডিকেট করে শিল্পপতিদের কাজে বাধা সৃষ্টি করা চলবে না। ভদ্রেশ্বরের ঘটনায় আমাদের কেউ যুক্ত আছেন বলে অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেব।” এর আগে হুগলিরই পোলবার রাজহাট এবং পাণ্ডুয়ায় দুই শিল্পপতিকে কারখানা গড়া নিয়ে তৃণমূলের হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল।
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে সমস্যা মেটে। এ বার দেখার, ভদ্রেশ্বরের প্রস্তাবিত কারখানার কী পরিণতি হয়। সমীরবাবু বলেন, “কারখানা নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি করা যাবে না। আমাদের যে এত ক্ষতি হয়ে গেল,তা কে মেটাবে?”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.