পাঁচ বছর আগেও গ্রামে পড়াশোনার রেওয়াজ প্রায় ছিলই না। শিশুরা স্কুলে গেলেও প্রাথমিকের গণ্ডীতেই থমকে যেত জীবন। কিন্তু তারপরে দিন বদলেছে। দুর্গাপুরের খাটগোড়িয়ায় এখন পাকা স্কুলবাড়ি থেকে গ্রামের মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতার জন্য সেলাই স্কুল, সবই মজুত। এই ভোল বদলের কৃতিত্ব অনেকটাই আমেরিকার এক অনাবাসী বাঙালি দম্পতির।
গ্রামে প্রায় ১১০টি পরিবার আছে। সবাই আদিবাসী। কয়েকজন চাষবাস করেন, বাকিদের ভাত জোগাড় হয় দিনমজুরি করে। পড়াশোনা বলতে দু’একজন জব্বরপল্লি, কমলপুর বা রঘুনাথপুরের প্রাথমিক স্কুলে গিয়েছেন। তবে ওই পর্যন্তই। গ্রামের দশরথ হেমব্রম, শিবদাস মুর্মুরা জানান, এক সময়ের দুর্গাপুরের বাসিন্দা বর্তমানে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স এডুকেশনের অধ্যাপক প্রতিমা রায় ও সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই রসায়নের অধ্যাপক তাঁর স্বামী রবীন্দ্রনাথ রায় এগিয়ে না এলে এই বদল সম্ভব হত না। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরাই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও মহিলাদের হাতের কাজের শেখার গুরুত্ব বোঝাতে থাকেন। শেষে ২০০৭ সালের ২১ জুন একটি টালির ঘরে ৪১ জন পড়ুয়াকে নিয়ে স্কুল চালু হয়। তাঁরাই পড়ুয়াদের শিক্ষার সরঞ্জাম, পোশাক, টিফিন এমনকী চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেন। এখন সেই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৫৩। সাত কামরার পাকা স্কুলবাড়িতে আলো-পাখার নীচে ক্লাস করে ছাত্রছাত্রীরা। খাটগোড়িয়া ছাড়াও বনশোল, বিজুপাড়া, লবণাপাড়া, রঘুনাথপুর-সহ ১০টি গ্রাম থেকে পড়ুয়ারা আসে। শিক্ষক আছেন ৭ জন। এ বছর সেই স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৭ জন। ৯ জন ছাত্র এবং ৮ জন ছাত্রী। আমরাই হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে তারা। স্কুল যাওয়ার জন্য তাদের প্রত্যেককে একটি করে সাইকেলও দেওয়া হয়েছে। প্রতিমাদেবী জানান, কোনও ভাবেই যেন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনায় ছেদ না পড়ে তাই এই উদ্যোগ। স্কুলেরই এক ছাত্র সুনীল কিস্কুর বাবা জনমজুর চুলকা কিস্কু, কিংবা সুখি টুডুর বাবা কারখানার ঠিকা শ্রমিক বিজয় টুডু সকলেরই এক কথা, “ভাবতেই পারছি না আমাদের ছেলে-মেয়েরা বড় স্কুলে পড়ছে।” |
চত্বরের অন্যদিকে রয়েছে আদিবাসী মহিলাদের জন্য সেলাই স্কুল। ২০১০ সালের নভেম্বরে ১০ জন গ্রামেরই মহিলাকে নিয়ে এই স্কুল শুরু হয়। প্রথমে প্রশিক্ষণ পরে রুমাল ও ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী উৎপাদনও শুরু করেন তাঁরা। দু’একটা করে সেগুলি বিক্রি শুরু হতেই আরও মহিলারা এগিয়ে আসেন। সেলাই স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ১৯৪ জন। প্রতিমাদেবী জানান, ২০০৯ সালে স্কুলের স্থায়ী পাকা বাড়ি গড়ার পরেই বদলে গেল ছবিটা। বাসিন্দাদের আস্থায় আর ঘাটতি ছিল না তখন। ধীরে ধীরে কেনা হল সেলাই মেশিন, এমব্রয়ডারি মেশিন, কম্পিউটার। সেলাই শিক্ষক শঙ্কর বর্ধন ও সোমা মুখোপাধ্যায়ের তত্বাবধানে শুরু হল প্রশিক্ষণ পর্ব। কিন্তু সমস্যা হল ভাষা নিয়ে। সমাধানে অলচিকি ও বাংলা দুই ভাষা জানেন এমন দুই আদিবাসী মহিলা গোলাপি মুর্মু ও সাদমোনি মুর্মুকে রাখা হল।
সেলাই শেখানোর পাশাপাশি প্রতিযোগিতার বাজারে লড়তে শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ গণিত শেখানো শুরু হয়। দেওয়া হয় কম্পিউটারের সাধারণ পাঠ। সোহাগি হাঁসদা, স্বর্ণজবা মুর্মু, মালতি সোরেন, কুমোদি বাস্কে, নলিকা হাঁসদারা এখন হাতের কাজের নানা জিনিস যেমন, টেবিল ম্যাট, ওয়াটার বট্ল কভার, ক্যানভাস, কার্ড, ইউনিফর্ম তৈরিতে রীতিমতো পোক্ত। ইতিমধ্যেই একটি বেসরকারি স্কুলের নার্সারির সাড়ে তিনশো পড়ুয়ার ইউনিফর্ম তৈরির বরাত পেয়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি তাঁদের তৈরি সামগ্রী বাক্সবন্দি করে প্রতিমাদেবী নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানে তা বিক্রি করে অর্থও ভাগ করে গিয়েছেন এদের। একেক জন গড়ে ২ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। এসব দেখে আশেপাশের ভাতুপাড়া, বনসোল, ধোওয়াডাঙা, পারুলিয়া, কমলপুর-সহ অন্যান্য গ্রামের মহিলারাও এখন সেলাই ও হাতের কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। প্রতিমাদেবীও বলেন, “সবে শুরু। এখন ১৬টি সেলাই মেশিন, ৭টি কম্পিউটার ও একটি এমব্রয়ডারি মেশিন রয়েছে। দোতলায় হলঘর গড়ার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। আরও দেড়শোটি সেলাই মেশিন ও ৫টি এমব্রয়ডারি মেশিনও কেনা হবে। প্রতিমাদেবীর স্বামী রবীন্দ্রনাথবাবু জানান, আমাদের পরেও যাতে এই উদ্যোগে ছেদ না পড়ে তাই ইতিমধ্যেই স্কুলটিকে দুর্গাপুরে আমার বাবা ও মায়ের স্মৃতিতে গড়ে তোলা এক ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের অছি পরিষদের আওতায় নিয়ে এসেছি। তিনি জানান, এই উদ্যোগে পাশে রয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক অশোকনাথ বসু এবং বর্তমান প্রো-ভাইস চ্যান্সেলার অধ্যাপক সিদ্ধার্থ দত্ত। অশোকবাবু বলেন, “এমন এক উদ্যোগের অংশ হতে পেরে গর্বিত।”
ওই দম্পতির কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনাও। তিনি জানান, জেলা জুড়ে ব্যক্তিগত এবং সংস্থাগত উদ্যোগে অনেকেই এই ধরণের কাজকর্ম চালাচ্ছেন। ওই দম্পতি দুর্গাপুরে যেভাবে শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার প্রয়াস চালাচ্ছেন তা প্রশংসনীয়। তিনি জানান, সেলাই স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে যদি কোনও দুঃস্থ মহিলা সেলাই মেশিন কিনতে চান তাহলে ‘ইকোনমিক্যাল রিহ্যাবিলিটেশন গ্রান্ট’ হিসাবে তাঁকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেবে প্রশাসন। পুরসভার শিক্ষা আধিকারিক সঙ্ঘমিত্রা দাশগুপ্ত জানান, ওই দম্পতি যেভাবে এগিয়ে এসেছেন তাতে আশা করা যায়, শিশুদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ বাড়বে। |