ক্লাস এইট। নাঃ! ঠেলেঠুলে তার বেশি আর এগোন যায়নি তাদের। দুই ছেলেই প্রথমে কেঁদে ভাসিয়ে, নানাবিধ বায়না করে তারপর স্কুল-পালিয়ে পড়াশোনাটাই ছেড়ে দিয়েছিল।
ছেলেরা ‘ইস্কুলে’ যাবে, বাবার মতো ‘আনাড়ি’ হবে না, বয়স যত গড়িয়েছে ততই মনে মনে স্বপ্নটা সাজিয়ে ছিলেন মহরম আলি। সে স্বপ্নের আর ঘুম ভাঙেনি।
শেষতক হাল ছেড়ে বছর পাঁচেক আগে নিজেই পড়াশোনায় নতুন করে মন দিয়েছিলেন মহরম। মধ্য চল্লিশে তাঁর দ্বিতায় ইনিংস। শুরু করেছিলেন সেই কবেকার ছেড়ে আসা ক্লাস এইট থেকেই।
তবে তাঁর দুই মেয়েও অবশ্য বাবার সঙ্গী ছিল। একই সঙ্গে দুলে দুলে সান্ধ্য-পাঠ তাঁদের। মেয়েদের খাতা দেখেই অঙ্ক কষা। তারপর এ বছর, দু মেয়ের হাত ধরেই ফাজিল (উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য) পরীক্ষায় বসেছিলেন মহরম। তিনি বলছেন, “পাশ করব কিনা জানি না। তবে কবেকার স্বপ্ন ছিল, এখনও উত্তেজনা কাটছে না জানেন।”
ডোমকলের জোড়গাছা গ্রামে তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে মহম্মদ মহরম আলি বলেন, “কত বার বুঝিয়েছি, যা বাবা, স্কুল থেকে ফিরলেই কমলা-আইসক্রিম। হল না। তারপর ফুটবল, শহরে নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্ট মোগলাই পরোটা খাওয়ানোর লোভ থেকে সাইকেলকত লোভ দেখালাম। শেষ দিকে দু-ঘা করে দিয়েও লাভ হল না। এ বার স্কুল পালানো শুরু করল। বুঝে গেলাম ওদের আর যাই হোক পড়াশোনা হবে না।” তারপর এক দিন ‘তোরা পড় লি নাতো এ বার দ্যাখ’ বলে বসে গেলেন তিনি। শুধু কথার কথা নয় সেটা প্রমাণও করে দিয়েছেন সাত চল্লিশের ওই ‘তরুণ’।
ছয়ঘরি সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তামাম এলাকায়। শিক্ষক, সহপাঠী এমনকি স্ত্রীও অবাক হয়ে গিয়েছেন মহরমের এমন কীর্তিতে। পাড়ার লোকজন বলছেন, ‘‘চাট্টিখানি কথা নয় বাপু। এই বয়সে আমরা যখন ছেলেমেয়ের বিয়ে-সাদি দিয়ে নাতি- পুতি নিয়ে হইচই করে দিন কাটাচ্ছি, তখন মহরম বইখাতা নিয়ে পড়াশোনা, ভাবাই যায় না।’’ |
ছয়ঘরি সিনিয়র মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই বয়সেও ওই ছাত্রের ইচ্ছে ও অধ্যাবসায় দেখে আমরা মুগ্ধ মহরম আলিকে দেখে সেটা সকলেরই শেখা উচিত। সংসারের নানান হ্যাপা সামলেও উনি নিয়মিত ক্লাস করতেন আশা করি রেজাল্টও ভাল হবে।’’
কি বলছেন মহরমের জুনিয়র সহপাঠীরা? আশরাফ আলি, আকতারুল ইসলামদের কথায়, ‘‘আমরা তো প্রথম দিন উনাকে ক্লাসে দেখে বুঝতেই পারিনি যে উনি আমাদের ক্লাসেই ভর্তি হয়েছেন তারপর আস্তে আস্তে বিষয়টি আমরা সকলেই জানতে পেরেছি উনি আমাদের বাবার বয়সী। কিন্তু আমাদের সকলের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মিশতেন। কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে আমাদের জিজ্ঞাসাও করতেন।’’ ছেলের বয়সী সহপাঠীদেরদেরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন মহরম তিনি বলেন,‘‘ শিক্ষকদের পাশাপাশি ওদের কাছেও আমি ঋণী, সে কথা মানতেই হববে।”
অল্প বয়সে পড়তে পারেননি মহরম। টানাটানির সংসার, সামান্য জমিতে মুনিশ লাগিয়ে চাষ করার জো ছিল না তাঁর বাবার। ছেলেকেও জুতে দিয়েছিলেন। তারপর আঠারো হওয়ার আগেই বিয়ে। সংসারের জাঁতায় পনে গড়িয়ে চলল সময়। পড়ার বইয়ে জমতে থাকল ধুলো। তাই দুই ছেলে পড়াশোনা শিখুক, বড্ড চেয়েছিলেন তিনি।
উঠোনের একপাশে কাঁঠালগাছের ছায়াতে দাঁড়িয়ে মহরম বলেন, ‘‘এক দিন রাতে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। ছেলেরা তো পারল না আমিই নতুন করে আবার লেখাপড়া শিখে ওদের দেখিয়ে দেব।’’
বাবার সঙ্গেই হাই মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন মহরমের দুই মেয়ে হামিদা ও হাসিনা। বাবার এমন মনোবল দেখে গর্বিত ওই দুই কন্যা বলেন, ‘‘প্রথমে আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে আব্বা আমাদের সঙ্গেই ফের স্কুলে যাবেন। কিন্তু এখন আব্বা আমাদের সহপাঠী। একসাথেই বাড়িতে পড়তে বসি অনেক সময় খাতা পেন নিয়েও আমাদের গন্ডগোল বেধে যায়।’’ স্ত্রী মকতেজান বিবি লাজুক হেসে বলেন, ‘‘ওঁর মনের জোর সাংঘাতিক। প্রথম প্রথম পাড়া গাঁয়ের লোকজন অনেক কথাই বলত। এই বয়সে স্কুলে যাওয়াকে অনেকে ভিমরতিও বলেছিল, কিন্তু এখন সকলেই ওকে সম্মান করে।’’
আর ছেলেরা? সেদিনের স্কুলছুট এক ছেলে এখন কর্মসূত্রে ভিনরাজ্যে। অন্য জন মোস্তাফিজুর রহমান, চাষআবাদ করেন। তিনি বলেন, ‘‘ বাবা সত্যিই আবার লেখাপড়া শুরু করে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, চেষ্টা তাকলে কী না হয়!” বাবা পারলে আপনারা আবার শুরু করতে পারেন না?
মাথা নিচু করে পড়ন্ত বেলায় মোস্তাফিজুর বলেন, “খুব ইচ্ছা হচ্ছে জানেন!” |