আয়োজক দিল্লি ক্রিকেট সংস্থা কি বিশেষ স্মারকটারক বানিয়েছে? ধুর, ভাবেইনি। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড থেকে বিশেষ কে উপস্থিত থাকছেন? কোনও খবর নেই। বরঞ্চ বোর্ড প্রেসিডেন্ট নিজেই তো বিদেশে।
মুম্বই থেকে স্ত্রী না ভাই, কে উড়ে আসছেন? কেউ না।
নিজে কোনও ইঙ্গিতটিঙ্গিত দিয়েছেন? একেবারেই না।
গোয়েন্দারা যেমন রহস্য সমাধানে নানান ক্লু-টুগুলো একত্রিত করে মূল ছবিটা বোঝার চেষ্টা করেন, তেমনই সচিন তেন্ডুলকর অবসর-রহস্যে ওপরের ইঙ্গিতগুলো জড়ো করে যেটা দাঁড়াচ্ছে তা হল কোটলা তাঁর ক্রিকেটজীবনের প্রান্তিক স্টেশন নয়। আর অবসরও এখানে ঘটছে না। টিম তেন্ডুলকরের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে থাকা এক সূত্র এ দিন মুম্বই থেকে জানাচ্ছে, দুশোতম টেস্ট খেলতে চান সচিন। শুক্রবার থেকে শুরু সিরিজের শেষ টেস্ট হতে যাচ্ছে তাঁর ১৯৮তম। অতএব বছরের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছেনই। অবসর তার পর ভাবা যাবে।
এ দিন ফোনে রবি শাস্ত্রী: অবসর এ ভাবে এখুনি বলা কঠিন। সিরিজ বাই সিরিজ ধরছে ও। প্রথম প্রায়রিটি একটা বড় রানের ইনিংস। যেটা দুর্ভাগ্যে বারবার আটকে যাচ্ছে।
এ দিন ফোনে গৌতম গম্ভীর: কোটলা ওর শেষ টেস্ট হোক একেবারেই চাই না। আমি চাইব এমন একটা ম্যাচে সচিন শেষ করুক যেখানে ড্রেসিংরুমে আমি যেন অবশ্যই থাকি।
অনেকের অবাক লাগছে যে, কোটলা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা হোলির আগের দিন। বল ঘুরলে হয়তো তারও আগে। আর দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়া নভেম্বর মাসের শেষে। মাঝে দেশে-বিদেশে কোথাও ভারত টেস্ট ক্রিকেট খেলছে না। ওয়ান ডে আছে মধ্যিখানে। কিন্তু সেখানে তো তিনি নেই। চল্লিশ বছরেরও বেশি বয়সি হয়ে আট মাস গ্যাপে টেস্ট ক্রিকেট সম্ভব হবে? তা-ও বিশ্বের এক নম্বর টিমের ভয়ঙ্কর গুহায় স্টেইন-ফিলান্ডাদের সামনে? শোনা যাচ্ছে, সেই রাস্তাও সচিন বার করে রেখেছেন। ইংল্যান্ড চলে গিয়ে মাঝের সময়টা তিনি ট্রেনিং করবেন। ওখানকার উইকেটে খুচখাচ প্রদর্শনী ম্যাচ-ট্যাচ খেলে তৈরি থাকবেন। |
হাতের কাছে কোনও নমুনা নেই, যে এমন মডেলে সাফল্য পেয়েছে। তাই দু’শো টেস্ট ম্যাচ যতই কায়মনোবাক্যে খেলতে চান, হালকা অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই। তার চেয়েও অনিশ্চয়তা, দেশের মাঠে আর কখনও টেস্ট খেলার সুযোগ পাবেন কি না?
বোর্ডের সফরসূচি অনুযায়ী নভেম্বরের দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে টেস্ট সিরিজ শুরু। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরতে না ফিরতেই ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে টিম চলে যাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। এর পর বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তার পর টিম ইন্ডিয়ার পূর্ণাঙ্গ ইংল্যান্ড সফর। সে-ই অক্টোবরে গিয়ে দেশের মাঠে আবার টেস্ট খেলা। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তখন সাড়ে একচল্লিশ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেট খেলার মতো অবস্থা থাকবে সচিনের?
যুক্তি তো বলছে, ১৯৯০-এ চণ্ডীগড়ে, কপিল দেবের বেড়ে ওঠা সেক্টর সিক্সটিন স্টেডিয়ামে ভারতে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল মরাঠির। অন্তত ভারতে শেষ টেস্ট ঘটে যাচ্ছে শুক্রবার থেকে কোটলায়।
এই সপ্তাহে ৪-০ হচ্ছে কি না-তে তাই আগ্রহ নেই। কোটলায় বিষ্যুদবারের সকালের নেটেও যাবতীয় কৌতূহল, জিজ্ঞাসা আর জল্পনা সেই তেন্ডুলকরকে ঘিরে। তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত জরিপ করা চলছে। নেটে তিন বার ব্যাট করেও আবার প্যাড না খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দ্রুত নোট করে নিল নবীন সাংবাদিক। কোচ ফ্লেচারের সঙ্গে ঝুঁকে পড়ে কথা বলছেন। ক্যামেরাম্যান ছুটল। হরভজনের সঙ্গে ইয়ার্কি-হাসিঠাট্টা। দ্রুত শাটার টেপার আওয়াজ। অন্য দিনের নৈমিত্তিক ব্যাপারগুলোও আজ যেন নতুন চোখ আর মাত্রায় ঘনঘন বিশ্লেষিত হচ্ছে।
সচিন নিজে মিডিয়ার সামনে এই মুহূর্তে আসার মতো বান্দাই নন। বিলক্ষণ জানেন তাঁর সম্ভাব্য অবসরের দিন-তারিখ নিয়ে কী পরিমাণ জল্পনা। কিন্তু এটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের ক্রিকেটচর্চায় মন দিতে চান। বড় রান চাই তাঁর। রাম কী ভাবল, যদু টিভিতে কী বলল আর শ্যাম কী লিখল-র চেয়ে নিজের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল, ২০১১-র জানুয়ারির পর টেস্ট সেঞ্চুরি নেই তাঁর। কে কী বলল তো মুহূর্তের চুটকি। রেকর্ডে থাকা রানগুলো নয়। সেগুলো চিরকালের জন্য থাকবে। মনে করিয়ে দেবে, এই সময়টায় তুমি কেমন খেলছিলে, ইতিহাসে আমরা তার পূর্ণ মানদ্যোতক।
অবসর সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা তাই বহু পিছনে চলে গিয়ে সচিনের মননে আগে উঠে এসেছে চিরসফল পেশাদারের প্রাসঙ্গিকতা। আমি যেন বরাবরের মতোই নির্ভরযোগ্য থাকি। কখনও যেন লোক হাসানোর পর্যায়ে নিজেকে না নিয়ে যাই। এটা যতই তাঁর মনোভাব হোক, মিডিয়া এবং এ দিনও প্র্যাকটিসে ঢুকে পড়া জনগণের মনে যে রোম্যান্টিক বসন্ত। কিন্তু তিনি, বিপন্ন ক্রিকেটরাজ কী করে সাড়া দেন ঋতুরাজের আমন্ত্রণে?
দিল্লি শহরের মধ্যে কোটলাকে বিছিন্ন ব-দ্বীপ তাই মনে হতে পারে। কারণ, মেট্রো রেলের কাজের জন্য শহরের সর্বত্র কাটাকুটিকে সাময়িক পিছনে ফেলে দিয়ে সেই শহরেই উঠে এসেছে কিনা ফুলের সবিস্তার সজ্জা। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, গাঁদা, লিলি, সূর্যমুখী, শিমুলের মেলা বসন্তকুঞ্জ থেকে চানক্যপুরী সর্বত্র। ইন্ডিয়া হ্যাবিটেট সেন্টারে চলছে স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল। গান, কবিতা, বই পড়া, লেখকের সঙ্গে আলোচনা। অঢেল খাওয়াদাওয়া। রাস্কিন বন্ড থেকে গুলজার। শোভা দে থেকে রামচন্দ্র গুহ। এক এক দিন এক এক জন অতিথি। রাজধানীর কেষ্টবিষ্টুরা শুরু করে দিয়েছেন প্রি হোলি ব্যাশ। সেখানে খান মার্কেট জাতীয় বাজারগুলো থেকে কেনা রঙিন সব গাঁধী টুপি পরে লোকে আগাম রং মাখছে। ভাঙ খাচ্ছে। তন্দুরি চিকেন কামড়াচ্ছে। আর কেউ কেউ ট্রাই করছে ভদকা-ফুচকা। ফুচকার মধ্যে তেতুঁল জলের বদলে ভদকা। চলছে ‘রং বরসে’ জাতীয় সব হোলির গান আর রিমিক্স আইটেম নাম্বার।
বসন্তের এমন রোম্যান্সেও ঢাকা পড়ছে না অবশ্য বাস্তবের কর্কশতা। যেমন একটা গুজব শোনা যাচ্ছিল, ক্রিকেট বোর্ড এমন অনাড়ম্বর ভাবে সচিনকে চলে যেতে দেবে না। স্রেফ সচিনের জন্য তারা তিন টেস্টে কার্যত বিদায়ী সিরিজ করবে। যার একটা টেস্ট অনিবার্য ভাবে হবে মুম্বইয়ে। সচিনের বিদায়ী সিরিজ নিয়ে প্রকারান্তরে তো বোর্ডেরও মুনাফা। টিভি থেকেই প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে। টিভি চ্যানেলেরও বিজ্ঞাপন টানতে লাভ। তার মানে, কেবল শ্রীলঙ্কা জাতীয় হাতে থাকা টিমকে ডেকে খেলিয়ে দাও ডিজাইনার সিরিজ। উইন-উইন পরিস্থিতি।
এ দিন ফোনে কিন্তু ভারতীয় বোর্ডের কর্তা আনন্দবাজারকে জানিয়ে দিলেন, এটা বোকা বোকা গুজব। বললেন, “ক্যালেন্ডারটা দেখুন। অন্য কোনও সিরিজ ভেতরে ঢোকাবার জায়গাই নেই।” তা হলে তো সচিনের এটাই দাঁড়াচ্ছে ভারতে খেলা শেষ টেস্ট? কর্তাটি বললেন, “সেটা একান্তই ওর ব্যাপার।”
দেশের মাঠে বিদায়ী টেস্টেও তা হলে আর পাঁচ জনের মতো হিসেবি, বাণিজ্যিক হওয়ার সুযোগ নেই? নিজের জীবনের দিকচিহ্নকে গুরুত্ব না দিয়ে বরাবরের মতো রান নামক মাস্তুল আঁকড়ে থাকতে হচ্ছে।
এটাই কি গ্রেট রোম্যান্স নয় যে, সায়াহ্নেও পেশার প্রতি অবিছিন্ন সমর্পণ থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে না চাওয়া? অবসরের ফুল আনুষ্ঠানিক ভাবে তাই ফুটুক না ফুটুক, কাটখোট্টা কোনও ঘোষণা বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাক বা না যাক, শুক্রবার থেকে কোটলায় ভরা বসন্ত!
|
...রাজধানীর কেষ্টবিষ্টুরা শুরু করে দিয়েছেন প্রি হোলি ব্যাশ। সেখানে খান মার্কেট জাতীয় বাজারগুলো থেকে কেনা রঙিন সব গাঁধী টুপি পরে লোকে আগাম রং মাখছে। ভাঙ খাচ্ছে। তন্দুরি চিকেন কামড়াচ্ছে। আর কেউ কেউ ট্রাই করছে ভদকা-ফুচকা। ফুচকার মধ্যে তেতুঁল জলের বদলে ভদকা ...
...একটা গুজব শোনা যাচ্ছিল, ক্রিকেট বোর্ড এমন অনাড়ম্বর ভাবে সচিনকে চলে যেতে দেবে না। স্রেফ সচিনের জন্য তারা তিন টেস্টে কার্যত বিদায়ী সিরিজ করবে। যার একটা টেস্ট অনিবার্য ভাবে হবে মুম্বইয়ে...
...ভারতীয় বোর্ডের কর্তা আনন্দবাজারকে জানিয়ে দিলেন, এটা বোকা বোকা গুজব। বললেন, “ক্যালেন্ডারটা দেখুন। অন্য কোনও সিরিজ ভেতরে ঢোকাবার জায়গাই নেই।” |
|