ইংরেজির উপর জোর দেওয়া চলিবে না, ঔপনিবেশিকতা নিপাত যাক: দিল্লিতে আওয়াজ তুলিয়াছেন বিরোধীরা, এমনকী শরিকরাও। বেগতিক দেখিয়া সরকার পিছু হটিয়াছে, পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়াছে। গত ১৪ তারিখ এই ‘ইংরেজি হটাও দেশ বাঁচাও’ কুনাট্যে সরগরম হইয়া উঠিয়াছিল লোকসভা। ইউপিএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষাজ্ঞানের উপর জোর বাড়ানোর প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত হওয়াতেই এই বিপত্তি। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব মুলতুবি হয়। ইংরেজি লইয়া এ দেশের রাজনৈতিক অশান্তি নূতন নহে। ইংরেজি-বাদীদের মধ্যে ঔপনিবেশিকতা, সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতা, আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত বৈষম্যবৃদ্ধির প্রয়াস ইত্যাকার অতি দুষ্ট প্রকৃতির প্রবণতা হামেশাই খুঁজিয়া পান ইংরেজি-বিরোধীরা। সাম্য ও ঐক্য জাগরণের পথে ইংরেজিই প্রধান অন্তরায়, তাঁহাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে ভর করিয়া তাঁহাদের দাবি, আইএএস, আইএফএস, আইপিএস, আইআরএস পদাকাঙ্ক্ষীদের যোগ্যতা নির্ধারণে ইংরেজি পত্রের নম্বর মোট-প্রাপ্ত নম্বরে যুক্ত করিবার নূতন প্রস্তাব বাতিল হউক।
কিন্তু ইউপিএসসি-র তরফে প্রস্তাবটি উঠিয়াছিল কেন? কেননা, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলে: উচ্চ পদাধিকারীরা অনেকেই নিজেদের বিভাগের গুরুতর আলোচনার লিখিত বা মৌখিক ভাষ্য তৈরি করিতে পারেন না। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বড় বাধা হইয়া দাঁড়ায় যথার্থ সংযোগী বয়ানের অভাব। প্রসঙ্গত ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদম্বরম সর্বসমক্ষে মন্ত্রকের এই অপারগতার কড়া সমালোচনা করিয়াছিলেন। তিনি ভুল বলেন নাই। প্রশাসনের দায়িত্ব যাঁহারা বহন করেন, তাঁহাদের জন্য ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষায় সাহিত্যিক দক্ষতা না থাকিলেও হইবে, কিন্তু সুষ্ঠু ভাবে কাজ চালাইতে ভাষায় ন্যূনতম যোগ্যতা আবশ্যিক।
এখন প্রশ্ন, কেন ইংরেজি? উত্তরটি সহজ: কেন ইংরেজি নয়? কোন যুক্তিতে ইংরেজি আজ অভারতীয় ভাষা? ঔপনিবেশিকতার বস্তাপচা যুক্তি বাদ দেওয়া যাক। উপনিবেশের ইতিহাস দেশের শাসনযন্ত্রের সর্বত্র বিরাজমান, কেবল ভাষাকে গাল দিয়া লাভ নাই। দেশের সংবিধান যে ভাষায় রচিত, স্বাধীনতার ঘোষণা যে ভাষায় শ্রুত, স্বাধীন দেশে প্রথমাবধি বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সরকারি আদানপ্রদান যে ভাষায় স্বীকৃত, সেই ইংরেজিকে অভারতীয় ভাষা বলা যায় কি? বরং যে-কোনও আঞ্চলিক ভাষা (হিন্দি অবধি) অপেক্ষা ইংরেজিই কি প্রকৃত বিচারে সর্বভারতীয় ভাষা নহে, কেননা দেশের সর্বত্র ইহার কমবেশি স্বীকৃতি রহিয়াছে? দেশের কিছু অংশে তীব্র হিন্দি-বিরোধী আবেগের কথা মাথায় রাখিয়াই ইংরেজির দাবিটি বিচার করা জরুরি। দেশব্যাপী চূড়ান্ত ভাষাবহুত্বের মধ্যে ইংরেজির বিশিষ্ট স্থানটি স্বীকার করা জরুরি। আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে গুরুত্ব দিয়াও আন্তঃ-অঞ্চল যোগাযোগে তাহার ভূমিকা মান্য করা জরুরি। ইতিহাসের যুক্তিটি ঘুরাইয়া দিয়া বলা যায় যে, ইতিহাসের কারণেই ইংরেজির এই গুরুত্ব, ভারতীয় বাস্তবটিই আসলে পাল্টাইয়া গিয়াছে। বাস্তববিমুখ পলায়নপরতা দিয়া আর যা-ই হউক, দেশশাসনের কাজ চলিবে না। |