আনহোনি কো ধোনি কর দে
ত বার কলকাতায় আসে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, ওর ‘মাস্ট-ডু লিস্ট’-এ একটা জিনিস থাকবেই। মাটির ভাঁড়ে দুধ, চিনি, এলাচ দেওয়া চা-টা ওকে খেতেই হবে। হয় শর্মা ধাবায়, না হলে পিজি হাসপাতালের উলটো দিকে যে ধাবা আছে সেখানে। যেমন ইচ্ছে, তেমন কাজ।
তাজবেঙ্গল থেকে সোজা আমরা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের শর্মা ধাবাতে রাতে হাজির। চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে চা খেয়ে আড্ডা মেরে ব্যাক টু তাজবেঙ্গল। আশেপাশে তখন সাঙ্ঘাতিক ভিড়।
মানুষ এবং গাড়ির। কিন্তু অত রাতে কেউ চিনতেও পারল না ভারতের সেরা পাঁচ সেলিব্রিটিদের মধ্যে একজন তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে চলে গেল। গল্পটা এ জন্য বললাম, কারণ আমার কাছে এই গল্পটা মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে চিনতে সাহায্য করে।
আজও নিজের শিকড় ছেঁড়েনি যে ছেলেটা, আজও নিজের মনে যা ইচ্ছে হবে সেটাই করবে, কেউ আটকাতে পারবে না।

ফোনে অ্যালার্জি
এমনিতে আমার সঙ্গে ধোনির প্রথম আলাপ ২০০৪-এ। তখন ও সবে সবে পাকিস্তানের সঙ্গে সেই বিধ্বংসী ১৪৮ করেছে। আমি তখন যে সংস্থায় কাজ করতাম, তারাই আমাকে ধোনির কাছে পাঠিয়েছিল। পরে অবশ্য আমার নিজের কোম্পানি খোলার সময় প্রচুর সাহায্য করেছিল এমএস। যা বলছিলাম, ২০০৪-এ দিল্লিতে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম দু’জনে। তার পর থেকেই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেই অনুষ্ঠানের পর আমাকে রাতে এসএমএস করেছিল, “হোপ এভরিথিং ওয়াজ ফাইন।” আমার ধারণা নিজের জীবনে ও আজ অবধি ৪০০র বেশি এসএমএস করেনি। এটা সেই চারশোর মধ্যে একটা। এটা মজা করে বললাম কিন্তু ধোনির সঙ্গে ফোনের সম্পর্ক বড্ড খারাপ। হি ইজ ভেরি ব্যাড অন দ্য ফোন। কিছুতেই কাউকে ফোন করবে না। কত বার হয়েছে ওকে তিন দিন ফোনে না পেয়ে ওর মা-বাবা এমনকী ওর দিদি আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন ও কেমন আছে। ‘থোড়া বোলনা উসকো ফোন করনে’ এ রকম অনুরোধ ওর পরিবারের কাছ থেকে আমার কাছে প্রায়ই আসত তখন। ধোনির অবশ্য তাতে কিছুই যায় আসে না। ও নিজে এ ব্যাপারে খুব পরিষ্কার। ওর ফোন ধরতে অ্যালার্জি আছে। এবং তাই নিয়ে ও লজ্জিত নয়। তার থেকে অনেক বেশি খুশি হয় ও হোটেলের ঘরে ভিডিয়ো গেমস খেলতে পারলে।

বাবা-মা’র সঙ্গে ধোনি লেফটেন্যান্ট কর্নেলের সম্মানে ভূষিত হচ্ছেন ধোনি

‘ওর ফোন নাম্বারটা দিস’
ভিডিয়ো গেমসের প্রসঙ্গ যখন এল তখন জানাই, ধোনির হোটেলের রুমে যদি আপনি যান, দেখতে পাবেন ঘরে প্রচণ্ড দামি কিছু রয়েছে। দেখবেন হুকা রয়েছে (হ্যাঁ, মাঝে মাঝে হুকা খায় এমএসডি) আর রয়েছে ভিডিয়ো গেমস। ওর প্রিয় খেলা হচ্ছে ‘শু্যটিং গেমস’ আর ‘বাইক রেস’। ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলতে পারে ও। এক বার তাজবেঙ্গলে আমি ওর ঘরে গিয়েছি। ও ভিডিয়ো গেমস খেলেই চলেছে। মাঝেমধ্যে একটা দু’টো কথা বলছে। ব্যস। আমি অসম্ভব বোর হয়ে এক বন্ধুকে ফোন করি। সে সেই সময় তাজবেঙ্গলেই ছিল। ওকেই বলি অমুক রুম নাম্বারে চলে এসো। আড্ডা মারব আমরা। সেই মতো বন্ধু এল। দু’জন মিলে অনেক ক্ষণ ধরে প্রচুর আড্ডা মারলাম। এমএসডি তখনও খেলেই চলেছে। যাওয়ার আগে আমার বন্ধুর সঙ্গে দু’মিনিট কথা বলল শুধু। বন্ধু ঘর থেকে চলে যাওয়ার পর বলল, “আমার মেয়েটাকে বেশ ভাল লাগল, ওর ফোন নম্বরটা আমাকে দিস।” সেই মেয়েটার নাম ছিল সাক্ষী। আজকের মিসেস মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।

হঠাৎ দেওয়ালে আপেল ছুড়ে মারল
আজকে যখন মাঠে ওকে খেলতে দেখি, তখন অনেক কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে কী অসম্ভব পাংচুয়াল এমএসডি। কোনও মিটিং যদি সকাল আটটায় থাকে তা হলে এক মিনিট দেরি ও করবে না। যাদের সময়জ্ঞান কম তাদের ওপর রেগেও যায় খুব।
অনেকেই ভাবেন, ধোনি রাগে না। কিন্তু সেটা বোধ হয় ঠিক নয়। মনে আছে, একবার কোনও একটা কারণে (কী কারণ বলতে পারছি না) ভীষণ রেগে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ একটা আপেল নিয়ে সজোরে দেওয়ালে ছুড়ে মারল। ব্যস রাগ শেষ।
তার পর থেকে আবার স্বাভাবিক। অনেক বার দেখেছি রেগে গেলে ও ড্রামাটিক কিছু করে। সেটা করার পরেই ও আবার মাটির মানুষ। হয়তো রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার ওটাই ওর পথ। অনেকে রেগে গেলে শুনেছি জিমে যায়। ও কিন্তু তার একেবারেই উলটো। জিমে যেতে ওর ঘোর অনিচ্ছা। আমি ওকে জিজ্ঞেসও করেছি বহু বার ও জিমে যেতে চায় না কেন? “আমি সারা দিন উইকেট কিপিং করার জন্য যত বার স্কোয়াট করি সেটাই যথেষ্ট। তার পর আর জিমে যাওয়ার দরকার হয় না,” এটাই ওর সাধারণ উত্তর।
আজকেও ভারতীয় দলের সব চেয়ে ফিট প্লেয়ার এমএসডি। তাই কে তর্ক করবে বলুন ওর সঙ্গে?
বিমানবন্দরে স্ত্রী সাক্ষীর সঙ্গে

ওর সব ব্যাপারে যুক্তি আছে
তবে তর্ক যে ও করে না তা কিন্তু নয়। অনেক বার হয়েছে ওর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা, ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ওর সঙ্গে তর্ক করেছি। ও নিজেও জানে আমরা যেটা বলছি সেটা ঠিক। কিন্তু ওর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ওর এতটাই আত্মবিশ্বাস আর কনভিন্স করার ক্ষমতা যে ও ভুল জিনিসটাকেও খুব যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারে। এবং এত ভাল করতে পারে যে এক সময় আপনি নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করবেন ও যেটা বলছে সেটাই ঠিক। ওর আত্মপ্রত্যয় খুব জোরালো। আর সব ব্যপারে ওর একটা জোরালো যুক্তি আছে, ব্যাখ্যাও আছে। আর একটা জিনিস দেখেছি ওর মধ্যে। ও সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারে না। সারা দিন নিজের হোটেল ঘরেই থাকে। হয়তো কিছুই করছে না, কিন্তু হোটেলেই থাকবে ও। ও নিজের প্রাইভেসিটা খুব পছন্দ করে। সেই জন্য অনেককেই বলতে শুনেছি এমএসডি-র খুব খারাপ অ্যাটিটিউড। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। ওর ছোটবেলার বন্ধুরাও আমাকে বলেছে ও বরাবরই এ রকম। শান্ত, একটু মুখচোরা। তবে ও কিন্তু খুবই মাটিতে পা রেখে চলে। আর বড্ড পছন্দ করে ছোটবেলার কথা বলতে।

কলকাতার বিরিয়ানি খায় আলু খাবে বলে
কত বার আমাকে খড়্গপুর থাকার সময় ওর জীবন কী রকম ছিল সেটা বলেছে। দারুণ উপভোগ করে ছোট বেলার কথা, রাঁচির কথা বলতে। এটাও বলেছে খড়্গপুরে কাজ করার সময় যখনই ও ছুটি পেত তখনই রাঁচি পালিয়ে যেত। পুরনো সম্পর্কগুলো কিন্তু আজও ভোলেনি। খড়্গপুরে থাকাকালীন এক জন কোচের কাছে প্র্যাকটিস করত। তার কিছু দিন পরে সেই কোচ মারা যান। তাঁর মেয়ের বিয়েতে আর্থিক ভাবেও সাহায্য করেছিল এমএসডি। ও যাকে মনে করে ওর বন্ধু, তার জন্য যা ইচ্ছা করতে পারে। আর ভালবাসে বাইক চালাতে। আজকে ওর বোধ হয় আঠাশটা বাইক আছে। মুম্বইতে আমার ফ্ল্যাটের নীচে ওর দু’টো বাইক থাকে হায়াবুসা আর ইনট্রুডার। মুম্বইতে এলেই ওই বাইক নিয়ে রাতে বেরিয়ে পড়ে। কার্টার রোডে বাইক চালাতে খুব পছন্দ করে। কলকাতাতেও আগে চালাত। কিন্তু আজকে যে হেতু এখানে শ্বশুরবাড়ি তাই বেশির ভাগ সময় সেখানেই থাকে। তবে কলকাতায় এলে একটা জিনিস ও খাবেই। তা হল আর্সালানের বিরিয়ানি। বিরিয়ানিতেও ওর সব চেয়ে প্রিয় হচ্ছে আলু। নিজেও বলে কলকাতার বিরিয়ানিটা খাই আলুটা থাকে বলে।


২০০৩-এ ইন্টার রেলওয়ে ট্রফি ম্যাচের পরে বন্ধুদের সঙ্গে। ধোনি তখন রেলের টিকিট পরীক্ষক

লাইফ ইজ আনফেয়ার, গেট ইউজড টু ইট
এক দিকে যদি ওর বিরিয়ানি ভাল লাগে তা হলে আর একটা প্রিয় জিনিস হচ্ছে কেনাকাটা। টি-শার্ট, ঘড়ি, বুটস কেনা ওর নেশা। এক সময় এড-হার্ডি টি-শার্ট খুব পছন্দ করত। তার পর এল প্রাদা, অ্যাবারক্রোমবি আর এফসিইউকে। আজকে যে হেতু রিবকের বিজ্ঞাপনে কাজ করছে ওর জন্য স্পেশাল টি-শার্ট বানিয়ে দেয় কোম্পানি। আর ভালবাসে বুটস কিনতে। এক বার তো অস্ট্রেলিয়া থেকে আরএম উইলিয়ামস-এর পনেরো জোড়া বুট কিনেছিল। আমাকেও উপহার দিয়েছে আরএম উইলিয়ামস-এর বুটস। এটা ওর নেশা। আজকে যখন দেখি ও এত সফল শুধু একটা জিনিস দেখেই আমার খারাপ লাগে। ওর চুল আর দাড়ি প্রায় সব পেকে গিয়েছে।
নাগপুরে বন্ধুর সঙ্গে
তাতে অবশ্য ওর কোনও হেলদোল নেই। “একশো চল্লিশ কোটির দেশে, ভারতীয় ক্রিকেট ক্যাপ্টেনের চুল পাকবে না তো কার চুল পাকবে?” এটা ওর স্ট্যান্ডার্ড উত্তর। আসলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ভীষণ বুদ্ধিমান এবং বড্ড বেশি বুদ্ধিমান। এক বার মনে আছে একটা টিম সিলেকশনের পর আমি বিবিএম স্টেটাস দিয়েছিলাম ‘আনফেয়ার সিলেকশন’। সঙ্গে সঙ্গে ও আমাকে লিখেছিল, ‘‘লাইফ ইজ আনফেয়ার, গেট ইউজড টু ইট’’। এতেই বোঝা যায় ও কতটা বাস্তববাদী।
আমার মতে বাস্তবাদিতা ছাড়াও এম এস ধোনিকে বোঝা যায় ওর প্রাইভেসি দিয়ে। মনে আছে দেরাদুনে যখন বিয়ে করল তখন পাঁচ-ছ’জন ছাড়া আর কেউ জানতই না। ওকেই জিজ্ঞেস করেছি দেরাদুনে বিয়ে করল কেন? অনেক বার আমাকে বলেছে ও নিজে পাহাড়ি বলে ওর খুব ইচ্ছে ছিল পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করবে আর পাহাড়ের কোনও জায়গায় বিয়ে করবে। পাহাড়ি মেয়ে তো হল না, কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে বিয়ে করল। ওর বিয়ে ছিল রবিবার। মনে আছে ওর একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ও বলেছিল ওকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র হচ্ছে, তাই যদি ওরা এক দিনের জন্য দেরাদুনে আসে। জন আর বিপাশাকেও শেষ মুহূর্তে ফোন করে নেমন্তন্ন করেছিল। ও যে জামাটা পরে বিয়ে করে সেটা আমি উপহার দিয়েছিলাম। সেটা ডিজাইনার নরেন্দ্র কুমারের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। কিন্তু কবে বিয়ে কোথায় বিয়ে, সেটা নরেন্দ্র কুমারকেও বলা হয়নি।
আজকে ওকে যখন দেখি তখন মনে হয় এমএসডির এত সাফল্য এসেছে কারণ ও নিজে কোনও কিছু নিয়ে মরিয়া নয় বলে। সাফল্য, ব্যর্থতা দু’টো নিয়ে ও খুব ক্যাজুয়াল। হ্যাঁ ও খুব ফ্ল্যামবয়েন্ট। হ্যাঁ, ওরও হতাশা হয়। কিন্তু সেটাকে কখনও প্রকাশ করে না। যাঁরা ওর নিন্দা করেন তাঁদের প্রসঙ্গ উঠতেই বলে ‘কর্মা’ ওদের শাস্তি দেবে। খুবই বিশ্বাস করে ‘কর্মা’তে। কোনও দিন দেখিনি কেউ কিছু বলেছে বলে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ‘‘অন্যদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা নিজের জীবনে এনো না’’ এ কথাটা প্রায়ই বলে এমএসডি।
আর আজকে সাক্ষীকে যখন দেখি ওর পাশে, বুঝতে পারি, এমএসডি-র উপর ওর একটা শান্ত প্রভাব তৈরি হয়েছে। সাক্ষীর জন্যই ও অনেক বেশি লোকের সঙ্গে মেশে।
তবে ওর ফোন ব্যবহারে ভীষণ অনীহা, বেচারি সাক্ষীও বদলাতে পারল না।

কলকাতায় ক্যাপ্টেন কুল



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.