মা ও মেয়ে একই সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। সাধারণ পাঠক্রমে মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবে ২৫ মার্চ। তার সপ্তাহখানেক বাদে আগামী ৪ এপ্রিল থেকে শুরু হবে দূরশিক্ষায় মায়ের পরীক্ষা। জলপাইগুড়ির দেশবন্ধুপাড়ার মা ও মেয়ের একযোগে পড়াশোনার কথা এখন বাসিন্দাদের মুখে মুখে ফিরছে।
দু’কামরার ভাড়া বাড়িতে দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন কবিতা সরকার। ছোট মেয়ে এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। বছর পনেরো আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরে কার্শিয়াং থেকে বাপের বাড়ি বেলাকোবায় চলে যান কবিতা দেবী। দুই মেয়েকে জলপাইগুড়ির একটি স্কুলে ভর্তি করান। মেয়েদের পড়ার খরচ জোটাতে নিজে সেলাই স্কুলে ভর্তি হয়ে যান। এখন তিনি নিজেই সেলাই দিদিমণি। মেয়েদের স্কুলে যাতায়াতের সুবিধের জন্য ২০০৯ সালে জলপাইগুড়িতে বাড়ি ভাড়া নেন তিনি। সেখানেই চলে সেলাই স্কুল। চল্লিশ জনের মতো ছাত্রী। সেলাইয়ের সঙ্গে হাতের কাজও শেখান। শহরের একটি স্কুলে চুক্তিভিত্তিক সেলাই শেখানোর কাজও করেন তিনি। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়। পরে আর পড়া হয়নি। কিন্তু ভাল জানেন নিদেনপক্ষে স্নাতক না হলে কোথাও চাকরির সম্ভবনাও নেই। তাই ২০১০ সালে দূরশিক্ষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। এ বছরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কবিতা দেবী বলেন, “মেয়েরা বড় হচ্ছে। ওদের উচ্চ শিক্ষার জন্য আয় বাড়াতে হবে। স্নাতক ডিগ্রি না থাকলে কোথাও পাকাপাকি চাকরির সুযোগ নেই। তাই লেখাপড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ হলে দূরশিক্ষায় স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় বসব।” |
কবিতা দেবী ও রেশমা। —নিজস্ব চিত্র
|
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ওপেন স্কুলের দূরশিক্ষার পাঠক্রমে বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ব ও ইতিহাস বিষয়ে পরীক্ষা দেবেন কবিতা দেবী। বড় মেয়ে করিশ্মা কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। দু’জন গৃহশিক্ষক রেখেছেন মেয়ের জন্য। কিন্তু কবিতা দেবীর গৃহশিক্ষক তাঁর দুই মেয়ে। নিজেদের বাংলা ও ইংরেজি নোট দেখে মাকে পড়ায় করিশ্মা। আর মায়ের ইতিহাস বই পড়ে মাকে নোট তৈরি করে দেয় ছোট মেয়ে রেশমা। করিশ্মার কথায়, “আমার বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষার আগে পড়ার সময়ে মাকে নিয়ে পড়তে বসতাম। আমাদের সিলেবাস অনেকটাই মিলে যায়। ব্যাকরণের সিলেবাসও এক। অসুবিধে হয় না।”
দূরশিক্ষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে কম্পিউটারের প্রাথমিক প্রশিক্ষণও নিয়েছেন কবিতা দেবী। দুই মেয়েকেও ভর্তি করেছেন কম্পিউটার ক্লাসে। স্কুল ছাড়ার প্রায় ২০ বছর পরে ফের মেয়েদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে কেমন লাগছে? দেশব ন্ধুপাড়ার বাড়িতে বসে কবিতা দেবী বলেন, “সামর্থ্য না থাকায় মেয়েদের সব বিষয়ে গৃহশিক্ষক দিতে পারিনি। একবার ভেবেছিলাম নিজের পড়ার খরচ বাঁচিয়ে ওদের গৃহশিক্ষক রাখব। মেয়েরা বারণ করল। ওদের উৎসাহেই পরীক্ষা দিচ্ছি। ডিগ্রি পাওয়ার পরে একটা পাকা চাকরি পেলে ওদের লেখাপড়ায় আর কোনও বাধা আসতে দেব না।”
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দেশবন্ধুপাড়ার ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়ে বই নিয়ে বিছানায় বসে। গ্যাস ওভেনের সামনে রাখা চেয়ারে বসে ইংরেজি ‘রিপোর্টিং’ তৈরি করছেন তাঁর মা। খাতায় হলুদ, তেলের দাগ। কবিতা দেবী বলেন, “সারাদিন সেলাইয়ের ক্লাস থাকে। সময় পাই না। রাতে বাড়ি ফিরে রান্না ও অন্যান্য কাজ ফুরোলে পড়তে বসি। এখন পরীক্ষা সামনে বলে রান্নার ফাঁকেও পড়ছি। রান্নাঘর ছেড়ে যাওয়া যায় না। পুড়ে যাবে তো। তাই লেখার ফাঁকে খুন্তিও নাড়ছি।” দুঃস্থ মহিলাদের নিয়ে একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেছেন কবিতা দেবী। সেলাই হাতের কাজ তৈরি করে গোষ্ঠীটি বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করে। কবিতা দেবী নিজেই গোষ্ঠীর নামকরণ করেছেন ‘প্রগতি’। |