পুঁচকে প্ল্যাটফর্মে যে ক’টা লোকাল ট্রেন থামে, তার যাত্রীরা দিনেদুপুরেও শুনতে পান ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক। দুপুরেই মাঝরাতের গা শিরশির করা স্তব্ধতা। যে দিকেই তাকানো যায়, সে দিকেই জঙ্গল।
শাল, শিমুল, আকাশমণি, ইউক্যালিপটাসের অরণ্যে ঘেরা ওই হল্ট স্টেশনের নাম কানিমহুলি।
পাণ্ডববর্জিত স্টেশনটা ভৌগোলিক বিচারে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মধ্যে। কিন্তু লাইন পেরিয়ে ও পারে গেলেই বাংলার জঙ্গল। সাকুল্যে চারটি মুদির দোকান ও একটি মাত্র সাইকেল স্ট্যান্ড সবই ঝাড়খণ্ডের দিকে। ব্যস্ত সময়েও ওই স্টেশনে ক্রেতা-বিক্রেতা-যাত্রী-আগন্তুক সব মিলিয়ে জনা কুড়ির বেশি হয় না। সব ক’টা দোকানেরই এমন অবস্থা যে, আপনার পরিচিত কোনও ব্র্যান্ডের আট আনা-এক টাকা দামের লজেন্স-চিউইং গামও মিলবে না। বিস্কুটের ব্র্যান্ডও সব বিটকেল রকমের। কিন্তু ওই সব দোকানেও বহুজাতিক সংস্থার বোতলে ভরা প্যাকেজ্ড ড্রিঙ্কিং ওয়াটার থরে
থরে সাজানো। সেগুলির মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে ঢের দেরি। হতদরিদ্র, আদিবাসী প্রভাবিত ওই এলাকার মানুষের কাছে ওই জল কিনে খাওয়া এক রকম বিলাসিতা। তা হলে কে কেনে ওই জল?
ঝাড়খণ্ডের জগন্নাথপুর গ্রামের বাসিন্দা, একটি মুদির দোকানের মালিক সুনীলকুমার হেমব্রম প্রশ্ন শুনে চুপসে যান। প্রশ্নটা দ্বিতীয় বার করায় মুখ নামিয়ে বলেন, “মাঝেমধ্যে কিছু লোকজন আসে এখানে। তাদের জন্য কিনে রাখতে হয়।” তারা কারা? “বলতে পারব না।” |
পশ্চিমবঙ্গের দিকে, স্টেশন লাগোয়া এক জঙ্গলের উদ্দেশে তর্জনী তুলে সিপিএমের কৃষক সভার নেতা হরিশ মাহাতো বলেন, “ওটা আমতোলিয়া গ্রাম। এই স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে বড়জোর এক কিলোমিটার। আমতোলিয়াতেই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস-কাণ্ডে অভিযুক্ত, এখনও পলাতক মাওবাদী স্কোয়াড-নেতা জয়ন্ত ওরফে সাহেবরাম মুর্মুর বাড়ি। আমাদের কাছে যা খবর, লোকাল ট্রেনে চেপে কানিমহুলি স্টেশনে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মাঝেমধ্যেই বাড়ি ঘুরে যায় জয়ন্ত। সঙ্গে থাকে ভিন্ রাজ্যের লোকজন। স্টেশনের দোকানগুলো থেকে তারা টুকটাক জিনিসপত্রও কেনে।”
ঝাড়গ্রাম থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের চিল্কিগড় পর্যন্ত যাওয়ার পর সেখান থেকে কানিমহুলি স্টেশন কিংবা স্টেশন লাগোয়া এ রাজ্যের জঙ্গল ঘেরা গ্রামগুলোয় যাওয়ার আর কোনও পাকা সড়ক মিলবে না। চিল্কিগড় থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার ভাঙাচোরা মোরাম রাস্তা ও চারটে জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছতে হবে কানিমহুলি স্টেশনে। ওই মোরাম রাস্তার উপর, চিল্কিগড় থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে মুরাকাটি গ্রাম। ওই পর্যন্তই যৌথ বাহিনীর টহলদারির সীমা। তার পর আর যৌথ বাহিনী এগোয় না। বলা ভাল, এগোনোর ঝুঁকি নেয় না।
এক পুলিশ অফিসারের কথায়, “ওই রাস্তার যত্রতত্র ল্যান্ডমাইন পোঁতা থাকতে পারে। ফাঁদে ফেলে হামলা চালালে আমরা বেরোনোর কোনও রাস্তা পাব না।”
যৌথ বাহিনীর বক্তব্য, যে দিক দিয়েই ঢোকা যাক, ভালুক খুলিয়া, কোশাফুলিয়া, আমতোলিয়ার মতো জঙ্গল-লাগোয়া গ্রামগুলোর দূরত্ব কোনও পিচ রাস্তা থেকেই ১৬-১৭ কিলোমিটারের কম নয়। এরই সুযোগ নিচ্ছে মাওবাদীরা।
কী ভাবে?
ভালুক খুলিয়া গ্রামের কৃষক নগেন হেমব্রম ও বিপিন হাঁসদা বললেন, “আমতোলিয়ার জঙ্গলে শালপাতা, কাঠ কুড়োতে গেলে ইদানীং দেখা যাচ্ছে অচেনা, হিন্দিভাষী কিছু মানুষকে। সাত-আট জনের ওই দলে কয়েক জন মহিলাও আছে। জঙ্গলে ঢুকতে গ্রামের অনেকেই ভয় পাচ্ছে।” এলাকায় ঠিকাদারির কাজ করা দিলীপ নায়েকের বক্তব্য, “জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামগুলিতে মাওবাদীদের আনাগোনা নতুন করে শুরু হয়েছে। কিন্তু আগের মতো এখন ওরা স্থায়ী ভাবে কোনও এলাকায় থাকছে না। হাতে গোনা কয়েক জন গ্রামবাসী ওদের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়ে দেখা করে আসছে। গ্রামগুলিতে ওরা
ঢুকছে কালেভদ্রে।” |
জঙ্গলমহলের ৩৫-৪০টি গ্রামে মাওবাদীদের লিঙ্কম্যানেরা এখনও সক্রিয়। অন্তত তেমনই জানালেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র। তাঁর বক্তব্য, “মাওবাদীরা রাজনৈতিক কৌশল পাল্টেছে। হিংসার বদলে তারা এখন পুরনো লিঙ্কম্যানদের মাধ্যমে নতুন নতুন ক্যাডার নিয়োগের উপর জোর দিয়েছে। ওই লিঙ্কম্যানেরাই নানা কারণে বিক্ষুব্ধ তরুণ-তরুণীদের বেছে বেছে জঙ্গলে অপেক্ষারত মাওবাদীদের সঙ্গে দেখা করতে পাঠাচ্ছে।”
লালগড়ে সিআরপি-র এক শীর্ষকর্তাও বলছেন, “গত তিন মাসের মধ্যে লালগড় ও সংলগ্ন এলাকায় প্রায় ২০ জন তরুণ-তরুণী ঝাড়খণ্ড ও ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদীদের শিবিরে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর। তাদের বাড়ির লোকদের দাবি, ভিন্ রাজ্যে তারা কাজ নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছে না। আমরা নজর রাখছি।”
এই সব কি তা হলে নতুন করে লালগড়-পর্বের প্রস্তুতি?
লালগড় বিক্ষোভের নেতা ছত্রধর মাহাতোর এক সময়কার ছায়াসঙ্গী বিরকাঁড় গ্রামের শ্যামল মাহাতো অবশ্য বলছেন, “এলাকার মানুষ এখনই নতুন করে কোনও আন্দোলনের পথে হাঁটবে না। এখন আমাদের সেই মানসিকতা নেই। আমরা দিব্যি শান্তিতে আছি।”
আসলে ওই স্তরের আন্দোলন করতে হলে যে জনসমর্থন প্রয়োজন, সেটা জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের পিছনে এই মুহূর্তে নেই। তা বলে মাওবাদীরা এখন আর জঙ্গলমহলেই নেই, এমন ভাবাটা ভুল। এবং তার সাক্ষ্য দিচ্ছে আপাত শান্তির মধ্যেও মানুষের ওই আতঙ্ক।
চাকাডোবা গ্রামের ব্যবসায়ী সোমনাথ মণ্ডল যেমন। বাঁশপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের কার্যালয় ওই চাকাডোবা গ্রামে। দোতলা সেই কার্যালয়ের ভিতর ও বাইরের দেওয়াল ছয়লাপ ছিল মাওবাদী স্লোগানে। রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পঞ্চায়েত অফিসে নতুন হলুদ রঙের পোঁচ মুছে দিয়েছে সে সব দেওয়াল লিখন।
কিন্তু পঞ্চায়েত অফিসের উল্টো দিকে সোমনাথবাবুর বাড়ির দু’টো দেওয়ালে এখনও লেখা ‘সিপিআই (মাওবাদী) জিন্দাবাদ, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল।’ ২০০৪ সালে পার্টির জন্মের সময়ে লেখা হয়েছিল ওই স্লোগান। সোমনাথবাবুর বাড়ির অন্য দিকের দেওয়ালে নতুন রং হয়েছে। কিন্তু ওই দেওয়াল দু’টি তেমনই আছে। কেন?
“যে-রকম আছে, থাক না। কী দরকার ঝামেলা বাড়ানোর,” উত্তর গৃহকর্তার।
চাকাডোবার এই দেওয়াল লিখন পড়ে নিতে অসুবিধে হয় না। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে লেখা ফিকে হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি মোছেনি। যেমন জঙ্গলমহল থেকে পুরোপুরি মোছা যায়নি মাওবাদীদের।
|