রাত এগারোটার বালি ব্রিজ। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে একটি মারুতি ওমনি ভ্যান। তার পাশে পাশে ছুটছে একটি মোটরবাইকও। চলন্ত মোটরবাইক থেকেই তিন যুবক মারুতির ভিতরে থাকা এক তরুণীর গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। চলছে অশ্লীল মন্তব্য ও ইঙ্গিতও। ভয়ে চালকের আসনে থাকা ওই তরুণীর বাবা গাড়ির গতি বাড়াতেই একটি পাথর উড়ে এল গাড়ির পিছনের কাচে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। তার পরেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল বাইকটি।
মঙ্গলবার রাতের এই ঘটনার পরেই সোজা বালি থানায় গিয়ে অভিযোগ জানান তরুণীর বাবা। রাতেই পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে দুই অভিযুক্তকে পাকড়াও করে। আটক করা হয় মোটরবাইকটিও। পুলিশ জানায়, ধৃতদের নাম অশোক চৌধুরী ও শিবু মণ্ডল। তারা দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা। তবে আর এক অভিযুক্ত পলাতক। তার খোঁজ চলছে। হাওড়া কমিশনারেটের ডিসি (সদর) নিশাত পারভেজ জানিয়েছেন, ধৃতদের বিরুদ্ধে ইভটিজিং ও গাড়ি ছিনতাইয়ের চেষ্টার মামলা রুজু হয়েছে।
কী ঘটেছিল ওই রাতে?
পুলিশ জানিয়েছে, বরাহনগরের বাসিন্দা এক ব্যক্তি তাঁর স্ত্রী, কলেজপড়ুয়া মেয়ে ও এক বন্ধুকে নিয়ে স্থানীয় একটি বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন। রাত দশটার পরে সেখান থেকে বেরোন তাঁরা। এর পরে গাড়ি নিয়ে কোন্নগরে বন্ধুকে পৌঁছতে যাচ্ছিলেন ওই ব্যক্তি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে। ওই ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছেন, ডানলপ মোড়ের কাছ থেকে ওই মোটরবাইকটি তাঁদের পিছু নেওয়া শুরু করে। মহিলাদের উদ্দেশে চলতে থাকে কুরুচিকর ইঙ্গিত। তা দেখে কিছুটা গতি বাড়িয়ে দেন ওই ব্যক্তি। এর পরেই জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে ওই যুবকেরা। আলমবাজারের বিএসএফ ক্যাম্পের কাছে গাড়িটি দাঁড়িয়ে গেলে ওই যুবকেরা মোটরবাইক নিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দিকে চলে যায়। এর পরে ওই ব্যক্তি গাড়ি নিয়ে বালি ব্রিজে ওঠার পরেই ফের হাজির হয় সেই যুবকেরা। ওই তরুণীর বাবা এ দিন বলেন, “মোটরবাইক নিয়ে কখনও গাড়ির পাশে, কখনও গাড়ির পিছনে ছুটছিল ওরা। ভয়ে এক সময়ে গাড়ির কাচ তুলে দিতে হয়।” অভিযোগ, এর পরেই গাড়ি লক্ষ করে পাথর ছোড়ে অভিযুক্তেরা। ওই ব্যক্তির স্ত্রী বলেন, “মোটরবাইকের মাঝে বসে থাকা যুবকটি পাথর ছুড়ে মারে। ভাঙা কাচে আহত হয় আমার মেয়ে। তবে ভাগ্য ভাল যে, প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।”
ওই ব্যক্তি জানান, মোটরবাইকটি উধাও হতেই তাঁরা ‘ডাকাত, ডাকাত’ বলে চিৎকার জুড়ে দেন। তার পরে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বালিঘাট স্টেশনের কাছে রাস্তায় কর্তব্যরত দুই পুলিশকর্মীকে বিষয়টি জানান তাঁরা। পুলিশের পরামর্শেই কোন্নগর যাওয়ার বদলে গাড়ি নিয়ে বালি থানায় যান তাঁরা। থানার ওসি দীপক সরকার অভিযোগকারীদের কাছ থেকে পুরো বিষয়টি শোনেন। তার পরে অভিযোগ দায়ের করার জন্য সময় নষ্ট না করেই ওই ব্যক্তি ও তাঁর বন্ধুদের নিয়ে তল্লাশিতে বেরোন বলে পুলিশ সূত্রের খবর। ওই ব্যক্তির স্ত্রী ও মেয়েকে থানায় মহিলা পুলিশকর্মীদের কাছে বসিয়ে রাখা হয়। খবর দেওয়া হয় বেলঘরিয়া থানা ও ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কন্ট্রোল রুমেও।
পুলিশ সূত্রের খবর, অভিযুক্তদের বিবরণে একটি কালো রঙের বাজাজ পালসার ও তার নম্বর প্লেটে ‘০৩৬’ নম্বর থাকার কথা বলেছিলেন ওই ব্যক্তি। অভিযুক্তেরা কোন দিকে যেতে পারে, তা আন্দাজ করে তদন্তকারী দলটি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দিকে যায়। দক্ষিণেশ্বর আইল্যান্ডের কাছেই একটি রেস্তোরাঁর সামনে ‘০৩৬’ নম্বর লেখা মোটরবাইক মেলে। তার মালিককে খুঁজতেই রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে অশোক বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গিয়েছে বেলঘরিয়া থানার পুলিশও। পুলিশের পাঁচটি গাড়ি ঘিরে ধরে রেস্তোরাঁটিকে। পুলিশ দেখে বিপদের আঁচ পেয়ে রাস্তায় দৌড়তে শুরু করে অশোক। পিছনে ধাওয়া করে পুলিশও। সেই ফাঁকে অশোকের এক সঙ্গী চম্পট দেয়। পুলিশ জানায়, কিছু দূর ধাওয়া করে অশোককে পাকড়াও করা হয়। পরে রেস্তোরাঁ থেকে ধরা পড়ে শিবু। তাদের নিয়ে আসা হয় বালি থানায়। হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (সদর) নিশাত পারভেজ বলেন, “আমাদের অফিসারেরা লিখিত অভিযোগ দায়ের করার জন্য দেরি না করে চটজলদি ব্যবস্থা নিয়েছেন।”
যদিও তাতে আতঙ্ক কাটেনি কলেজপড়ুয়া ওই তরুণীর। এ দিন বাড়িতে বসে তিনি বলেন, “সিনেমায় এমন ঘটনা দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে যে এই অভিজ্ঞতা হবে, তা ভাবিনি।”
প্রশ্ন উঠেছে রাতে ডানলপ, আলমবাজার এলাকার নিরাপত্তা নিয়েও। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক কর্তা দাবি করেছেন, ওই এলাকায় রাতে টহলদারির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ওই কর্তার আশ্বাস, “ওই এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলির উপরেও নজরদারি বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” |