প্রবন্ধ ২...
বংশে বাতি দেবে যে মেয়ে
আমি সে পাখিটিকে স্বপ্নে দেখে থাকি
যে সাদা ভোরবেলা শিরিষ গাছটির
আবছা ডালে-ডালে কেবল বলে চলে,
‘গেরস্তের ঘরে কোল-আলো খুকি হোক।’
অমনি বেজে ওঠে ফুর্তি, হুল্লোড়;
বংশে বাতি দেবে যে-মেয়ে তার মুখ
গিনিতে দেখে নিতে মানুষ জড়ো হয়,
মানুষ কক্ষনো ডাইনি বলে আর
আধলা ইঁট তুলে ছোঁড়ে না ওর চুলে,
ছিন্ন কুসুমের মতন মেয়েদের
ভাসে না বৃতি আর মশলা-ধোয়া জলে,
হয়তো কোনোদিন। স্বপ্ন মনে হয়।

কবিতাটি লিখে, এর নাম দিয়েছিলাম, ‘ইউটোপিয়া’। কেননা, এমনটি হয় না। পরিবর্তে, মেধাবিনী, স্কলার মেয়েকে মেরে ফেলা হয়, লস্যিতে মারকিউরিক ক্লোরাইড মিশিয়ে, স্বামীর উন্নতির মই হিসাবে ব্যবহৃত না-হওয়ার অপরাধে বধূটিকে খুন করে আলমারির তাকে তুলে রাখা হয়, দুর্গন্ধ না-বেরোনো পর্যন্ত। দহেজ না-পাওয়ার শোকে, বিয়ের কনেকে তন্দুরের মধ্যে ঢুকিয়ে অঙ্গার করে ফেলা হয়েছিল। ধর্ষণ করা হয় বৃদ্ধাকে, প্রৌঢ়াকে, যুবতীকে, কিশোরীকে এবং তিন-চার বছর বয়সের শিশুকন্যাকে। ধর্ষক পুরুষ কখনও অনাত্মীয়, কখনও আত্মীয়, শ্বশুরমশাই, দাদা, বাবা...
কিছু দিন আগে, ২৪ জানুয়ারি, পালন করা হল জাতীয় শিশুকন্যা দিবস। আমি একটি কার্নিভালে গেলাম। গ্রামগঞ্জের মেয়েরা নাচল, গাইল, হাসল, ছবি আঁকল আর তাদের জন্য অনেকটা আকাশ-বাতাস, মাঠ-ময়দান আর রং ঢেলে দিয়ে দূর থেকে অভিভাবকের সতর্ক দৃষ্টি ঘিরে থাকল, হাজার হোক, কন্যাসন্তান বলে কথা। পুরুষের লোলুপ কবল থেকে বাঁচাতে হবে তো!
তখন অদৃশ্য গ্লো-সাইন হয়ে জ্বলজ্বল করছিল কয়েকটি পরিসংখ্যান। ৪ বছর বয়সের আগেই প্রতি ৪ জন মেয়ের ১ জন অত্যাচারের শিকার হয়। ৫ থেকে ৯ বছরের মেয়েদের ৫৩ শতাংশ নিরক্ষর। ভারতে বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়েছে। ৫০ শতাংশেরও বেশি মেয়ে এ দেশে স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায় না। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের (২০০৫-০৬) তথ্য অনুসারে সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গে সব থেকে বেশি কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায় এবং সব থেকে বেশি কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়।
পারিবারিক কাহিনিতেই শুনেছি, কোনও এক আত্মীয়ার পর পর শুধুই মেয়ে সন্তান জন্মেছে বলে তাঁকে কোনও শুভ কাজে ডাকা হত না। এ সেই কালো ইতিহাস, যার সূত্র মিলছে, হাঁড়িতে করে, মুখে নুনচাপা দিয়ে সদ্যোজাত কন্যাটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে চুপিসাড়ে যখন। যে ইতিহাসের সূত্র মিলে যাবে অনেক পরেও। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কালে যখন আলট্রাসোনোগ্রাফিতে কন্যাভ্রূণ দেখে ফেললে, গর্ভবতীর জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সেই ভ্রূণ নির্মূল করা হবে। আর, এই রিচুয়াল তো আমাদের ঘরে-ঘরে। সাধভক্ষণের অনুষ্ঠানে বাচ্চা একটা ছেলের হাতে ভাবী মা পায়েস খাবেন, যাতে তিনি যথাসময়ে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। দেখেছি, পরিবারে তিন চার জন জা থাকলে, যিনি পুত্রের জননী, তাঁর আদর খুব। আর, যিনি কেবল কন্যার জন্ম দিয়ে চলেছেন, সেই মেয়েটি মুখ কালো করে অসম্মানের জীবন কাটাচ্ছেন। সব চেয়ে বিপজ্জনক কথা হল, তাঁর মধ্যেও কাজ করে অপরাধ ও গ্লানিবোধ।
এ সব বাদ দিয়ে, আনন্দে কন্যাকাল! উচ্চারণ করতে গলা কেঁপে উঠল নাকি আমার! কিন্তু না, আসুন, বরং নিজেরাই নিজেদের চেতনা জাগাই মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে। সম্মান করতে শিখি মেয়েদের। আদর করি। মেয়ে জন্মালে শাঁখে ফু দিয়ে ভাবনার তরঙ্গ পাঠাই দিকে-দিকে যে, বংশে বাতি দেওয়ার জন্য আমাদের পরিবারে একটি ফুটফুটে পরি নেমে এল আজ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.