অভিরূপ সরকার লিখেছেন, ‘শিক্ষার বহু মাপকাঠিতেই পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। সেই অবস্থা থেকে উঠে আসার কাজটা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। তার জন্য সময় লাগবে। কিন্তু একটা চেষ্টা অন্তত শুরু হয়েছে। সরকার ঠিক পথে হাঁটছে।’ (‘আমরা শুরু করেছি অনেক পিছিয়ে থেকে’, ২৬-২) প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সূত্র হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন নতুন দিল্লির ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর ২০১২ সালে প্রকাশিত রিপোর্টটিকে। রিপোর্টটির শিরোনাম ‘এলিমেন্টারি এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া, প্রোগ্রেস টুওয়ার্ডস ইউ ই ই-২০১২’। ২০১০-১১ পর্যন্ত তথ্য ওই রিপোর্টে আছে। রিপোর্টের আরও কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য সঙ্গে দেওয়া হল। |
যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত রিপোর্ট সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে তার পূর্বের নাম ছিল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। গত ২০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়-শিক্ষা সম্পর্কে ওই সংস্থার প্রত্যেকটি রিপোর্টে এই রাজ্যের শিক্ষা, বিশেষ করে বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার প্রসার ও শিক্ষার্থীদের মান দেশের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন অন্য একটি সংস্থা আছে, নাম তার ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং। এই সংস্থার অন্তত গত ২০ বছরের বার্ষিক রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়-শিক্ষার বিকাশের সপ্রশংস উল্লেখ আছে। কয়েক বছর পর পর কেন্দ্রীয় সরকারের ‘এডুকেশন সার্ভে রিপোর্ট’-এও এ রাজ্যের বিদ্যালয়-শিক্ষার সার্বিক অগ্রগতির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কান্তি বিশ্বাস। ভূতপূর্ব স্কুলশিক্ষা মন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা-৩৯
|
অভিরূপবাবু এ রাজ্যে বিদ্যালয় শিক্ষা সম্পর্কে যে নিশ্চয়তা দেখাচ্ছেন, সেটা নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা এড়ানো যাচ্ছে না। বাম আমলে কিছুই হয়নি বলে তাঁর যে মন্তব্য সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। কালানুক্রম মেনে দ্বিতীয় বিষয়টি আগে বিবেচনা করা যাক। মৌলিক শিক্ষাক্ষেত্রটিতে বামফ্রন্ট সরকার যে অবহেলা দেখিয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, বাম আমলে কিছুই হয়নি। বাম সরকার প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত আদিবাসী, দলিত ও মুসলমান শিশুদের প্রতি বহমান বঞ্চনার পাপস্খালনের একটা অপ্রতুল উদ্যোগ নেয় ১৯৯৮ সালে, শিশুশিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই সামান্য উদ্যোগটাও কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার সুযোগ প্রসারিত করে তাদের মধ্যে শিক্ষার গুণগত চাহিদা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, এ রাজ্যের দীর্ঘকালীন ইতিহাস হচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরের ধাপের সুযোগ না-থাকা। অভিরূপবাবু ঠিকই বলেছেন যে, আমাদের রাজ্যে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু তিনি যেটা বলেননি সেটা হল, বাম আমলেই এই খারাপের মধ্যেও কিছুটা ভালর দিকে যাওয়া শুরু হয়েছিল এবং সেটা শুরু হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের কারণেই। অভিরূপবাবু যে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তাদের মতেই ২০০২-০৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুপাত ছিল ৮.৩, যা ২০১০-১১ সালে কমে দাঁড়ায় ৫.৫-এ। এই একই সময়কালে শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা বেড়েছে ৮৩ শতাংশ, যা সব রকম বিদ্যালয় মিলিয়ে দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশ। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
|
বর্তমান সরকার যেখান থেকে শুরু করল, সেটা দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেই সামগ্রিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোড়: শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯ চালু হল। এই আইন অনুসারে, যে সরকারই আসুক না কেন, বসতির ১ কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক ও ৩ কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলতেই হবে। এবং এই প্রক্রিয়ায় যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তা যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতা নয়, তেমনই জঙ্গলমহলে যে টাকায় মেয়েদের হস্টেল তৈরি হচ্ছে, তা-ও রাজ্য সরকারের ‘নিজস্ব’ নয়।
আগের সরকার এবং পরের সরকারের কাজের তুলনা (যাতে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনও তফাত দেখা যাচ্ছে না) না করে, যদি তুলনাটা রাজ্যের বিভিন্ন অংশে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি প্রয়াসে বৈষম্যের করা হয়, এবং তা নিরসনের প্রয়াস করা হয়, তা হলে হয়তো রাজ্যের শিক্ষার মান সামগ্রিক ভাবে কিছুটা এগোতে পারে।
পরিসংখ্যান বলে, আমাদের রাজ্যে সংসাধনের অভাব যতটা প্রকট, তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা তার ঠিক সদ্ব্যবহার। এই সরকারও এর সমাধানে খুব একটা সক্রিয় হয়েছে বলে প্রমাণ নেই। এখনও ৩০ শতাংশ স্কুলে বাড়তি শিক্ষক, ৩৯ শতাংশ স্কুলে ঘাটতি। এই ঘাটতি প্রান্তিক এলাকায় অনেক বেশি। লক্ষণীয়, আগের সরকার বিদ্যালয়ে যে জিআইএস ম্যাপিং করেছিল, তার ব্যবহার এই সরকার করছে না।
স্কুল নির্মাণ ও তার পরিকাঠামোর উন্নতি যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি তা চালানোর সুষ্ঠু পরিবেশ ও নীতি।
সংগ্রাম মুখোপাধ্যায়। কলকাতা-৭৪ |