যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ বিল পাশ হল। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল। নতুন আইনে কতটা বাড়বে
মেয়েদের আত্মবিশ্বাস? সমাজের মানসিকতা না পাল্টালে সে বিশ্বাস ফিরবে কি?
শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত |
কয়েক দিন আগে বেঙ্গালুরুর একটি কাগজ থেকে জানতে পারলাম যে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিরাট জনসভার আয়োজন করেছিলেন নারী আন্দোলনের কর্মীরা। সেখানে জোরালো বক্তব্য শোনা যায় রাজস্থানের ভাটেরি গ্রামের ভাঁওয়ারী দেবীর মুখে, ২১ বছর আগে ১৯৯২-তে যিনি নিজের গ্রামে গণধর্ষিত হন। একটি সরকারি প্রকল্পের কর্মী হিসেবে গ্রামে বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রচার করার অপরাধে গ্রামীণ সমাজের প্রভাবশালী অংশ তাঁকে ওই শাস্তি দেয়। কিন্তু যে ভাঁওয়ারী দেবীর দীর্ঘ কঠিন সংগ্রামের ফলে আমরা ১৯৯৭ সালে পেয়েছি কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন রোধে প্রথম ভারতীয় আইন, আজ তিনি কেমন আছেন? লড়াইয়ে অবিচলিত, অসমসাহসী ভাঁওয়ারী দেবী বলেছেন, ‘আমার গ্রামে আমি ও আমার পরিবার আজও একঘরে’ (ব্যাঙ্গালোর মিরর, ১০ মার্চ ২০১৩)। অথচ তাঁর ওপর বলাৎকার করা অপরাধীরা অতি অল্পদিন হাজতবাস করে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ভাঁওয়ারী বলছেন, ‘আমাকে এত পুরস্কার-টুরস্কার দিয়ে কী হবে? যদি ন্যায়-বিচার দিতে পারো তো দাও।’ এই ন্যায়-বিচারের দাবির মধ্যে অবশ্যই পড়ে আইন প্রণয়ন করা এবং দ্রুত তদন্তের মধ্যে দিয়ে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। কিন্তু ভাঁওয়ারী দেবী এবং আরও শতসহস্র মেয়েদের বেলায়, ন্যায় মানে কি শুধুই অপরাধীদের কঠোরতর থেকে কঠোরতম শাস্তির প্রয়োজন নিয়ে আলোচনা? যদি অপরাধীরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হত, তা হলেই কি ভাঁওয়ারী দেবী ও তাঁর পরিবার নিজেদের সমাজে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারতেন? গত ডিসেম্বরে, দিল্লির সেই রাতের পরও যদি দামিনী বেঁচে যেত, অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক সাজা পেলেও কতটা মৌলিক পরিবর্তন হত তার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্পে? |
শাস্তি চাই, আইন চাই। সেটুকুই যথেষ্ট? নাগরিক মিছিল, দিল্লি, জানুয়ারি ২০১৩। |
মেয়েটি আজ নেই। কিন্তু দেখছি তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কেন্দ্রীয় বাজেটে সম্প্রতি ১০০০ কোটি টাকার ‘নির্ভয়া ফান্ড’ ঘোষিত হয়েছে। এ দেশের মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার মহৎ উদ্দেশ্যে এই ১০০০ কোটি টাকার উদার বরাদ্দ/তহবিল যখন উৎসর্গীকৃত হতে দেখা গেল, তখন আমরা এও দেখলাম যে, অভূতপূর্ব দ্রুততায় ঘটে গেল বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কমিটি ও ক্যাবিনেটের বৈঠকের উদ্যোগে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধার্থে অর্ডিন্যান্স উত্থাপন, তা নিয়ে জোর আলোচনা, এবং শেষ পর্যন্ত বিল পাশ। কয়েকটি বিতর্কিত ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহলের মধ্যে চাপান-উতোরের খবরও জানতে পেরেছি। সবচেয়ে বেশি ঝড় উঠতে দেখেছি সহবাসে সম্মতির বয়স ১৮ থেকে ১৬ করার প্রস্তাব নিয়ে। অনেকের মতে, এর মাধ্যমে ১৮ বছরের কমবয়সিদের বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে প্রবেশ করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। অথচ দেখুন, নাবালিকা বিবাহ কী ভাবে কমিয়ে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ দেওয়া যায়, তা নিয়ে তাঁরা কোনও সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন না। আর আইনমতে বিবাহযোগ্যতার বয়স ও সহবাসে সম্মতির বয়স ১৮ হলেও কার্যক্ষেত্রে ১৮-র আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বহুসংখ্যক মেয়ের, এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা স্বামীদের অধিকার দিয়েই রেখেছে ১৫ বছরের বেশি বয়সি স্ত্রী-এর সঙ্গে যৌন সঙ্গম চালানোর! অতএব, বাস্তব পরিস্থিতি হল, কোনও ১৬/১৭ বছরের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে, এবং দিনের পর দিন তাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হলেও আইনের তাতে কাঁচকলা!
বিলটি পাশ হওয়ার আগে যখন তীব্র বিতর্ক চলছে, সেই সময়ই নারী আন্দোলনের কাজে ঘোরাঘুরির সূত্রে দেখেছি যে, দেশ জুড়ে মেয়েদের ওপর বেড়ে চলা যৌন-হিংসার জেরে, সর্বত্র মেয়েদের, বিশেষত অল্পবয়সি মেয়েদের, পথেঘাটে বেরোনোর আত্মবিশ্বাসে কতটা ফাটল ধরেছে। প্রশ্ন হল, নতুন আইন এল বলে ভবিষ্যতে এই গল্পগুলো কতটা পাল্টে যাবে, কতটা বৃদ্ধি পাবে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস? মহিলা-পুলিশ-সেবিত আলাদা থানা নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে-থাকা মেয়েদের মনে সাহস জোগাতে পারবে কি? সেই থানা এবং পুরুষ কর্মী-সেবিত সব থানায়, সব কোর্ট-কাছারিতে সব স্তরের কর্মীদের লিঙ্গ-ন্যায়ের পাঠ দেওয়া না হলে সত্যিকারের পরিবর্তন আশা করা যাবে কি? আসল কথা সমাজের নানা প্রান্তে মেয়েদের মধ্যে আইনি অধিকারগুলোর জোরদার এবং লাগাতার প্রচার চাই। না হলে পরিবর্তন আসবে না। তা ছাড়া চাই আইনের প্রয়োগের ব্যবস্থা। আইন পাশ হলেও আইনের প্রয়োগের দিকটা নিয়ে অবহেলা যদি চলতেই থাকে, বিচারব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের, বিশেষত মেয়েদের ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের সহজ নাগালের মধ্যে আনার জন্য আন্দোলন যদি দানা বেঁধে না ওঠে, তা হলে নতুন ও কঠোর আইনের হাত ধরে আমরা মোটেও এগোতে পারব না। এই ভয়টা কিন্তু সমানেই চেপে ধরছে, কেননা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের অতিরিক্ত আইন-মনস্ক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যতখানি মনোযোগ ব্যয়িত হচ্ছে আইন তৈরির কাজটির দিকে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যখন নাগরিক সমাজের দৃষ্টিও নিবদ্ধ কেবল কঠোরতর আইন প্রণয়নের অভিমুখে, তখন সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু আলোচনার বৃত্তের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। অথচ সেগুলি আলোচনার কেন্দ্রে না নিয়ে এলে সংবেদনশীল বিচারব্যবস্থার দিকে এগোনো এবং লিঙ্গ-অসাম্যের ভিত টলানো খুবই মুশকিল।
কথাটা আরও গুরুতর এই জন্য যে বর্মা কমিটির রিপোর্ট কিন্তু এই দিকটি ধরিয়ে দিয়েছিল। ওই রিপোর্টের প্রতিটি অধ্যায়ে বার বার বলা হয়েছিল, সুশাসনের অভাবই মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী এবং বর্তমানে যত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশাবলি রয়েছে, তার অনেকগুলোই রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের অভাবে কার্যকর হয়নি।
বর্মা কমিটি তৈরির সময় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বলছিল। কঠোর আইন চেয়ে প্রতিবাদীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তখন ছিল ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে মুখর। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই সময়েও নাগরিক সমাজের অপেক্ষাকৃত ছোট অংশের মধ্যে থেকে কিন্তু কতকগুলো প্রশ্ন উঠছিল, যেগুলো পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করে। ছেলে ও মেয়েদের ছোট থেকে কী ভাবে আলাদা সামাজিকীকরণ হয়, প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজ কেমন ভাবে পৌরুষের প্রকাশকে বাহাদুরি মনে করে ‘রেপ কালচার’কে প্রশ্রয় দেয়, কোনও মেয়ে যৌন অত্যাচারের শিকার হলে আমরা কেন বেশির ভাগ সময় তার ওপর হওয়া অপরাধের দায় তার ঘাড়েই চাপিয়ে দিই এ ধরনের প্রশ্ন কাগজে-টিভিতে, ঘরে-বাইরের নানা আড্ডায় দু-তিন সপ্তাহের জন্য হলেও উঠতে শুরু করেছিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই এই আলোচনায় বিভিন্ন ভাবে যোগ দিচ্ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে নারী আন্দোলনের বা অন্য কোনও সংগঠিত আন্দোলনের প্রত্যক্ষ যোগ নেই। কিন্তু দেখা গেল, সচেতনতা তৈরির জন্য কোনও আন্দোলনের অভাবে, উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল নতুন আইন প্রণয়নের সরকারি প্রচেষ্টা।
আসলে আলোচনার সংস্কৃতিকে আমরা সামাজিক মানসিকতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে পারলাম না, কারণ ভাবনামূলক রাজনীতি/reflexive politics-এর থেকে প্রতিক্রিয়ামূলক রাজনীতি/reactive politics-এর রাস্তাটা নেওয়া সব সময়ই অনেক সহজ। অথচ লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে কঠিন পথটা নিতেই হবে, এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। কী ভাবে সেই কঠিন পথ হাঁটতে হবে, তার একটা দিশা বর্মা কমিটি রিপোর্টেই ছিল, তাই দিশাহীনতার অজুহাতও এখানে খাটবে না। মনে রাখতে হবে, বর্মা কমিটির রিপোর্টের ভূমিকাতেই এই তাৎপর্যপূর্ণ কথাটা ছিল যে, আইনি পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকলেও শাসনব্যবস্থায় দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন না এলে, যে সামাজিক মানসিকতা ও লিঙ্গ অসাম্যমূলক আচরণের জন্য মেয়েরা যৌন-নিগৃহীত হয়, তার প্রতিকার করা অসম্ভব।
সুতরাং আইন থাকুক আইনের জায়গায়, সঙ্গে চলুক মানসিকতা পরিবর্তনের আন্দোলন। নেতাদের মধ্যেও আলোচনা চালাতে বাধ্য করুক নাগরিক আন্দোলন। অল্প কয়েক দিনের জন্য হলেও যে প্রশ্নগুলো উঠতে শুরু করেছিল, নাগরিক সমাজকে সেগুলো জিইয়ে রাখতে হবে, যাতে আমাদের সরকার না মনে করে যে ‘সুশাসন’ কথাটার মানে কেবলমাত্র আইন প্রণয়ন। আমরা যদি আলোচনার পরিসর বাড়িয়ে বাড়িয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জায়গায় জোর না দিই, রাষ্ট্রের তথা সমাজের লিঙ্গ-পক্ষপাতদুষ্ট জগদ্দল কাঠামোটায় নাড়া পড়বে না। বরং নিজেদের কাজটা হালকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের কাজটাও অনেক হালকা করে দেওয়া হবে। ভাঁওয়ারী দেবীদের জন্য ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যাবে। নির্ভয়াদের বুকে ফুল জমতে জমতে পাথর হয়ে উঠবে, মালা জমতে জমতে পাহাড়।
|