নরেন্দ্র মোদী এবং নীতীশ কুমার, উভয়েই যে নেত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেছেন, তাঁহার নাম ইন্দিরা গাঁধী। এবং যে পথে তাঁহাদের এই অনুসরণ, তাহা গণতন্ত্রের পথ। আক্ষরিক অর্থেই গণতন্ত্র। কথাগুলি আপাতশ্রবণে অ-সম্ভব মনে হইতে পারে, কিন্তু তাহা আপাতশ্রবণের নিজস্ব ত্রুটি। ষাটের দশকের শেষভাগে শ্রীমতী গাঁধী আপন দলের প্রবীণ এবং প্রতিপত্তিশালী নেতৃগোষ্ঠীর মহড়া লইবার জন্য যে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক অভিযান চালাইয়াছিলেন, তাহার যথার্থ তাৎপর্য এখনও সম্পূর্ণ লেখা হয় নাই, হয়তো তাহার জন্য কৌটিল্যের পুনরাবির্ভাব আবশ্যক। কিন্তু নেহরুতনয়ার মূলমন্ত্রটি ছিল সহজ এবং সরল। গোষ্ঠীতন্ত্রের দাপট ও দর্প চূর্ণ করিতে তিনি গণতন্ত্রের আশ্রয় লইয়াছিলেন। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। আপন ব্যক্তিত্ব, নীতি এবং কৌশল সহযোগে সরাসরি জনসাধারণের সমর্থন আদায় করিয়া তিনি সে দিন পরাক্রমী ‘সিন্ডিকেট’কে ময়দানের বাহিরে পাঠাইয়া দেন, রাজনীতিতে ইন্দিরা-যুগের সূচনা হয়। আরও তিন দশক আগে গাঁধী পদবিসম্পন্ন আর এক নেতা দলের সিদ্ধান্তকে আপন প্রভাব ব্যবহার করিয়া উল্টাইয়া দিয়াছিলেন, কংগ্রেস সভাপতির পদ হইতে সুভাষচন্দ্র বসুর প্রস্থান ঘটিয়াছিল, কিন্তু সেই পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, ত্রিশের দশকের মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী আর ষাটের দশকের ইন্দিরা গাঁধীর দূরত্ব দশকে পরিমাপ করা যায় না। ‘নবীনা’ ইন্দিরার নিকট সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হইয়া প্রবীণ দলনেতারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করিয়াছিলেন, গণতন্ত্র অতি বিষম বস্তু।
ওই অপ্রিয় সত্যটি ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সঙ্ঘ পরিবারের, বিশেষত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতা এবং গোষ্ঠীপতিরা নিশ্চয়ই মর্মে মর্মে টের পাইতেছেন। নরেন্দ্র মোদীকে উদ্দেশ করিয়া তাঁহারা কেহই ‘আমার পরান যাহা চায়’ গাহিতে চাহেন না। মোদী তাহা জানেন। তিনি দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তথা প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হইবার অধিকার অর্জনের জন্য পরিবারের অন্দরমহল হইতে আপন স্বীকৃতির মূলধন সংগ্রহ করিতে তৎপর হন নাই, আপন রাজ্যের বিপুল এবং ধারাবাহিক জনসমর্থনের কঠিন মাটিতে দাঁড়াইয়া বৃহত্তর ভারতের পরিসরে সেই সমর্থন প্রসারিত করিবার চেষ্টা চালাইতেছেন। তাঁহার অশ্বমেধের ঘোড়া কত দূর অবধি পৌঁছাইতে পারিবে, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সুষমা স্বরাজও অস্বীকার করিতে পারিবেন না, নেতৃত্বের খেলাটিকে মোদী দল বা সঙ্ঘের বৃত্ত হইতে জনতার ময়দানে আনিয়া দিয়াছেন। ইনডোর খেলা আউটডোর হইয়াছে। ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত, ভিন্ন পরিস্থিতি, কিন্তু নীতীশ কুমার সম্পর্কেও কথাটি মূলত সত্য। এন ডি এ’র পরিসরে এবং, ক্রমশ, সর্বভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তর মঞ্চে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী যে নিজস্ব আসনটি দাবি করিতেছেন এবং এ পর্যন্ত সেই দাবির স্বীকৃতি অর্জনে সফল হইয়াছেন, তাহা ব্যাপক জনসমর্থনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এন ডি এ’র শরিকরা জানে, ভোটের লড়াইয়ে এই ভিতটির মূল্য অপরিসীম। এবং, ভোট বিনা ক্ষমতা নাই। এই সত্য কংগ্রেসের অজানা নহে। কিন্তু এ পর্যন্ত রাহুল গাঁধীর উত্তরাধিকার বলিতে তাঁহার পিতামহীর পদবিটুকু। |