|
|
|
|
|
|
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ |
কলকাতার ‘কেনা-বেচা’
‘সিটি অফ জয়’ শুধু রসগোল্লা আর রাজনীতি নিয়ে
আকচাআকচির শহর নয়। বিদেশের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা
দিয়ে মুদ্রা কিংবা আগাম পণ্য লেনদেন হচ্ছে এখানে।
লিখছেন অরিন্দম সাহা |
|
|
শুধু মিষ্টি দই বা রসগোল্লার কেনা-কাটা নয়। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নির অঙ্কেও সাধারণ মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে কলকাতা। দেশের ডেরিভেটিভ লেনদেনের অন্যতম বড় বাজার রয়েছে এখানে। যার হাত ধরেই দেশের লেনদেনের মানচিত্রে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে এই শহর। ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমে শেয়ার ও পরে অন্যান্য এক্সচেঞ্জের সাহায্যে গড়ে উঠেছে পণ্য ও মুদ্রা লেনদেনের এক বিশাল বাজার। আর এতে ইন্ধন জুগিয়েছে মানুষের ঝঁুকি নেওয়ার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা।
ব্যবসা-বুদ্ধিতে বিদেশি
বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় মুদ্রা, তার পর রয়েছে পণ্য এবং সব শেষে শেয়ার। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে পণ্যের তুলনায় ১০ গুণ ও শেয়ারের চেয়ে ১০০ গুণ বড় হল মুদ্রার বাজার। দেখা যায় কলকাতার লগ্নিকারীরাও এই ভাবেই বিদেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।
লগ্নির এই তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে বর্তমানে মুদ্রা এবং শেয়ার বাজারে কিছুটা অস্থিরতা চলছে। যার ফলে বিনিয়োগকারীদের টানছে পণ্য লেনদেনের বাজার। আর মানুষের এই উত্সাহ দেখেই গত কয়েক মাসে বিদেশ থেকে নিয়মিত পণ্য লেনদেন বিশেষজ্ঞরা এই শহরে এসেছেন।
কলকাতার গুরুত্ব কতটা?
কলকাতার অবস্থানগত সুবিধা লেনদেনের এই বাজার বাড়াতে সাহায্য করেছে। এই শহরে বি বা দি বাগ বা সল্টলেকের মতো জায়গা লেনদেনকারীদের মূল ঘাঁটি। যাকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়, বরং সমগ্র পূর্ব ভারতেই ব্যবসা ছড়াতে উদ্যোগী হয়েছে এক্সচেঞ্জগুলি। রয়েছে মানবসম্পদের সুবিধাও। কলকাতা ছাড়াও, বর্ধমান, আসানসোল, শিলিগুড়িতে পণ্য লেনদেনের বাজারে পা রাখছেন বহু মানুষ। আর অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে গুয়াহাটি, পটনা, রাঁচি, জামশেদপুরের মতো শহরে ব্যবসা বাড়াচ্ছে এক্সচেঞ্জগুলি।
লগ্নি করেন কারা?
সারা দেশের মতো কলকাতাতেও বিভিন্ন ধরনের লগ্নিকারী রয়েছেন। কেউ হয়তো ভবিষ্যতের জন্য পণ্য কেনেন। আবার কেউ একই দিনে বিভিন্ন পণ্য কেনা-বেচা করেন। আসুন দেখে নিই সাধারণ ভাবে এই লগ্নিকারীদের কত ভাগে ভাগ করতে পারা যায়। |
|
হেজার্স
প্রথমেই বলে রাখা উচিত, অনেক লগ্নিকারী খোলা বাজারে পণ্যের দাম কী হবে, তার ভিত্তিতেই পণ্য লেনদেন করেন। আবার অনেকে একই ভাবে দামের ওঠা-পড়ার ঝঁুকি কাটাতে পণ্য লেনদেনের বাজারে লগ্নি করেন। আপনিও চাইলে ভবিষ্যতে পণ্যের দাম বাড়বে ধরে নিয়ে আগে থেকেই পণ্য কিনে রাখতে পারেন। যার ফলে দাম বাড়লেও, তা আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই ভাবে ভবিষ্যতের ঝঁুকি এড়িয়ে লগ্নি করার পদ্ধতিকে বলা হয় ‘হেজিং’। আর যাঁরা এ ভাবে লগ্নি করেন, তাঁদের বলা হয় ‘হেজার’। এখন বহু লগ্নিকারী এই ধরনের লেনদেন করে থাকেন। যাঁদের মধ্যে কর্পোরেট ও খুচরো বিনিয়োগকারী ছাড়া রয়েছেন কৃষকরাও।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ মনে করছেন আগামী মার্চ মাসে তাঁর এক কুইন্টল আলু প্রয়োজন হবে। কিন্তু একই সঙ্গে সেই সময়ে দাম বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তখন তিনি ফেব্রুয়ারিতেই কুইন্টলে ৮৩০ টাকা দরে একটি আগাম লেনদেনের চুক্তি করে রাখলেন। এ বার দেখা গেল মার্চে খোলা বাজারে সত্যি সত্যিই আলুর দাম বেড়ে হল ১,০০০ টাকা। তখন তিনি এক্সচেঞ্জে তাঁর পণ্য বিক্রি করে লাভের ১৭০ টাকা (১,০০০-৮৩০=১৭০ টাকা) পেলেন।
সেই সময়ে তিনি আলু বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। অথবা চাইলে পণ্য বিক্রি করে লেনদেনের বাজার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে খোলা বাজার থেকে ১,০০০ টাকা দরে আলু কিনলেন। যাই করুন না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর নিজের পকেট থেকে গেল মাত্র ৮৩০ টাকা। অর্থাত্ বাজারের ওঠা-পড়া তাঁকে স্পর্শ করতে পারল না।
স্প্রেড ট্রেডার্স
দু’টি ভিন্ন দিনে একই পণ্যের দামের তফাতকে বলে ‘স্প্রেড’। অর্থাত্ পণ্য লেনদেনের বাজারে মার্চ মাসে যদি ১০ গ্রাম সোনার দাম হয় ৩১,০০০ টাকা। আর মে মাসে একই পরিমাণ সোনার দাম ৩২,০০০ টাকা। তা হলে সেই ১,০০০ টাকার তফাত্ হল ‘স্প্রেড’। এখন যদি বাজার মনে করে যে ভবিষ্যতে সোনার দাম বৃদ্ধি পাবে, সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, মার্চের তুলনায় মে মাসের সোনার দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। বুদ্ধিমান লগ্নিকারীরা অনেক সময়েই এই দামের তফাতের ভিত্তিতে কেনা-বেচা করেন। এই পদ্ধতিই ‘স্প্রেড ট্রেডিং’। আর যাঁরা এই ভাবে লগ্নি করেন, তাঁদের বলে ‘স্প্রেড ট্রেডার’। অ্যালগো ট্রেডার্স
নাম শুনলেই বোঝা যায় যে, এই ধরনের লগ্নিকারীরা লেনদেনের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। এই ‘অ্যালগোরিদ্ম’ ভিত্তিক সফটওয়্যারগুলিতে নির্দিষ্ট কোড থাকে। যা লগ্নিকারীকে পণ্য কেনা-বেচায় সাহায্য করে। বর্তমানে কলকাতায় এই ধরনের লগ্নিকারীর সংখ্যা প্রচুর। আইআইটি, আইআইএম, আইএসআই, এক্সএলআরআই ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে থেকে পাশ করা পড়ুয়ারা নিয়মিত এই ধরনের সফটওয়্যার তৈরির কাজ করেন। সাধারণত সি++ বা ডট নেট-এর মতো সফটওয়্যার জানা লোকের চাহিদা প্রচুর।
কী ভাবে হয় লেনদেন? ভারতের বাজার যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ব বাজারকে অনুসরণ করে, তাই সেখানে দাম বাড়লে সাধারণত দেশেও পণ্যের দাম বাড়ে। অর্থাত্ আমেরিকায় আগাম লেনদেনের বাজারে যদি সোনার দাম আউন্স পিছু ১,৬৭০ ডলার হয়, তা হলে সফটওয়্যারের হিসাব মতো দেশে ১০ গ্রামের দাম হবে ৩০,১০০ টাকা। এ বার দেখা গেল এমসিএক্সে সেই দাম দাঁড়িয়েছে ৩০,০৫০ টাকা। ঠিক তখনই সফটওয়্যার নিজে থেকে ওই সোনা কেনার জন্য আবেদন জমা করে দেয়। যে-মুহূর্তে সেই দাম ৩০,১০০ টাকায় পৌঁছয়, সফটওয়্যার নিজে থেকেই পণ্য বেচে ৫০ টাকা লাভ করে নেয়। এই একই কাজ লগ্নিকারী নিজেও করতে পারেন। কিন্তু দেখা যায়, ঠিক সময়ে আবেদন না-করায় তাঁর হয়তো ক্ষতি হয়ে গিয়েছে অথবা কম লাভ হয়েছে। কারণ এই লেনদেনে দামের তফাত খুব কম সময়ের জন্য থাকে।
|
এক নজরে |
• শেয়ার লেনদেনকারী শহরগুলির ভিতর কলকাতার স্থান প্রথম চারে। বাকি শহরগুলি হল দিল্লি, মুম্বই ও আমদাবাদ।
• কমোডিটি ডেরিভেটিভ কেনা-বেচার নিরিখে ভারতে প্রথম স্থানে রয়েছে কলকাতা।
• দেশে মুদ্রা বাজারের প্রথমে রয়েছে মুম্বই এবং তার পরেই কলকাতার স্থান।
• কলকাতা, জামশেদপুর, পটনা, বর্ধমান ও শিলিগুড়িতে এক্সচেঞ্জ-গুলির নথিভুক্ত সদস্য রয়েছে।
• পূর্ব ভারতের অন্যান্য শহরে সর্বভারতীয় সদস্যদের (যাদের একাধিক স্থানে শাখা রয়েছে) মাধ্যমে এই লেনদেন চলে।
• পূর্ব ভারতে ৫ হাজারেরও বেশি আর্থিক লেনদেনকারী সংস্থা আছে।
• বেশির ভাগ সংস্থাই হয় সাব-ব্রোকার, নয়তো বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্রোকার (অথরাইজড পারসন) বা এক্সচেঞ্জ সদস্যদের শাখা হিসেবে কাজ করে।
• পূর্ব ভারতে এমসিএক্স-এর প্রায় ৩০০ সরাসরি নথিভুক্ত সদস্য রয়েছেন। |
|
টেকনিক্যাল ট্রেডার্স
প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে লেনদেন করার ব্যবস্থা অনেকদিন ধরেই চালু রয়েছে বাজারে। তবে মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রেই এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। তার পর রয়েছে পণ্য লেনদেনের বাজার এবং সব শেষে শেয়ার। বিভিন্ন ওয়েবসাইট বিনামূল্যে কোনও পণ্য কেনা বা বেচার জন্য এই ধরনের ‘বাই’ (কেনা) অথবা ‘সেল’ (বেচা)-এর ইঙ্গিত দেয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় দিনের লেনদেন শেষ হয়ে যাওয়ার পর। তাই হঠাত্ কোনও খবরে সেই ইঙ্গিতও পরিবর্তিত হতে পারে। এই ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে যাঁরা লেনদেন করেন, তাঁরাই টেকনিক্যাল ট্রেডার।
পোজিশনাল ট্রেডার্স
সাধারণ লগ্নিকারীদেরই এই পর্যায়ে ফেলা হয়। বাজারে পণ্য সম্পর্কে যা যা তথ্য পাওয়া যায়, সেই জ্ঞান দিয়েই তাঁরা লেনদেন করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, লগ্নির সময়ে তাঁরা বাজারের ওঠা-পড়ার সামনে কিছুটা অসহায় হয়ে পড়েন। এই ধরনের লগ্নিকারীরা ক্ষতি মেনে নিতে চান না।
জবার্স
এই লগ্নিকারীদের কাছে একটি ‘এক্সেল শিট’ থাকে। যার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে বিভিন্ন পণ্যের দামে ওঠা-পড়া থাকে। তাই কোনও পণ্যে ক্ষতি হলে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সেটি বেচে বেরিয়ে আসেন বা নতুন পণ্য কেনেন। প্রতি সেকেন্ডে লেনদেন করেন বলে এঁদের অসম্ভব ধৈর্য এবং অধ্যবসায় থাকতে হয়।
কলকাতায় এই ধরনের লগ্নিকারীর সংখ্যা প্রচুর। ঝঁুকি নিতে পারার ক্ষমতার জন্য প্রতি দিনই কয়েকশো তরুণ-তরুণী এই পেশায় আসছেন। এঁরা প্রতি দিন বেচা-কেনা করেন। এমনকী কোনও কোনও সময়ে একটি পণ্য কেনার কয়েক সেকেন্ড পরেই তা বিক্রি করে আবার নতুন পণ্য কেনেন। কলকাতার মতো অন্য কোনও শহরে এত বেশি সংখ্যায় ‘জবার্স’ দেখা যায় না। ‘অ্যালগো ট্রেডার’-এর পর এই শহরে ‘জবার্স’-দের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
আরবিট্রেজার্স
পূর্ব ভারতে অনেক লগ্নিকারীই এই পদ্ধতিতে লগ্নি করেন। একই সময়ে বিভিন্ন এক্সচেঞ্জে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের দামের তফাতের ভিত্তিতে লগ্নি করা হয়। যদি সোনার দাম দু’টি এক্সচেঞ্জে আলাদা হয়, তা হলে এই লগ্নিকারীরা যেখানে দাম কম সেখান থেকে সোনা কেনেন। আর অন্য এক্সচেঞ্জে তা বিক্রি করেন। দামের তফাতটুকুই তাঁদের লাভ।
|
ব্রোকার পরিচিতি |
পণ্য লেনদেনের জন্য যে ব্রোকারের সঙ্গেই যোগাযোগ করুন না-কেন, প্রত্যেক লগ্নিকারীর উচিত প্রথমেই সেই ব্রোকারের পরিচিতি ভাল ভাবে জেনে নেওয়া। তাঁর বা তাঁর সংস্থার লেনদেন করার যোগ্যতা রয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্য সেই ব্রোকারের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, মূল সংস্থার এফএমসি রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখে নিন। কলকাতায় এমসিএক্স, এনসিডিইএক্স-এর মতো এক্সচেঞ্জগুলির অফিসে গিয়ে সেই নম্বর যাচাই করে নিন। |
|
লেখক এমসিএক্স স্টক
এক্সচেঞ্জ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট, (মতামত ব্যক্তিগত)
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
|
|
|
|
|