দায়বদ্ধতায় তুড়ি মেরে যতই শৃঙ্খলা ভাঙুন, প্রশ্রয়ের ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে!
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগী ফেলে দল বেঁধে চড়ুইভাতি করতে যাওয়া জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে তদন্তও ধামাচাপা দেওয়া হল সেই ‘ঐতিহ্য’ রক্ষার তাগিদেই। যেমন তদন্ত শিকেয় উঠে গিয়েছে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, আর জি কর এবং রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমের ক্ষেত্রেও।
কোন পরিস্থিতিতে নীলরতনের ১১৬ জন জুনিয়র ডাক্তার কাউকে কিছু না-জানিয়ে, ছুটি অনুমোদন না-করিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে তাজপুরে বেড়াতে চলে গিয়েছিলেন, তার তদন্ত হচ্ছে বলে সোমবার জানান স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই স্বাস্থ্যকর্তাই মঙ্গলবার প্রশ্রয়ের সুরে বললেন, “কয়েকটা বাচ্চা ছেলের বেড়াতে যাওয়া নিয়ে অনেকটাই বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”
স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা আগে বলেছিলেন, হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে বলা হয়েছে। কী ভাবে সেই তদন্ত হচ্ছে, এ দিন তা জানতে চাওয়া হলে নীলরতনের অধ্যক্ষ শ্রীকান্ত পুরকায়স্থ সাফ জানিয়ে দেন, আলাদা করে কোনও তদন্তই হচ্ছে না। কারণ, তাঁর কথায়, “ছুটির দিনে সকলে মিলে আনন্দ করে বেড়াতে গেলে তার মধ্যে তদন্তের কিছু থাকে না।” হাসপাতাল সূত্রের খবর, তিরস্কার বা শাস্তি তো দূরের কথা। অধ্যক্ষ বিষয়টি নিয়ে কোনও জুনিয়র ডাক্তারকে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদও করেননি।
তা হলে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা কীসের ভিত্তিতে তদন্তের কথা বলেছিলেন? তিনি কি জুনিয়র ডাক্তারদের এ ভাবে হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা খুঁজে পেয়েছিলেন? সুশান্তবাবু এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাননি। এই প্রশ্নে নীরব নীলরতনের অধ্যক্ষও।
সর্বোপরি নির্বিকার ভাব দেখিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও। তাঁর প্রশ্ন, “কে, কোথায় বেড়াতে যাবে, তা নিয়েও আমাকে কথা বলতে হবে নাকি?”
অর্থাৎ শুধু অধ্যক্ষ বা স্বাস্থ্যকর্তা নন, খোদ মন্ত্রীও ওই তদন্ত নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করতে নারাজ। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে তদন্ত ধামাচাপা পড়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। গত বছর ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, তার আগের বছর আর জি কর এবং এসএসকেএমেও একই ভাবে কাজ ফেলে বেড়াতে চলে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। প্রতি বারেই বিষয়টি নিয়ে হইচই হয়েছিল বিস্তর। তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। তার পরে আর কিছু জানা যায়নি। কোন পরিস্থিতিতে, কাদের টাকায় জুনিয়র ডাক্তারদের এই বেড়াতে যাওয়া, প্রতিটি ক্ষেত্রে তা রহস্যই থেকে গিয়েছে। নীলরতনেও।
বারবার তদন্তের কথা জানালেও শেষ পর্যন্ত তা ধামাচাপা পড়ে যাওয়াতেই কি এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা?
স্বাস্থ্যকর্তা সুশান্তবাবু বলেন, “আগে কী হয়েছে, জানি না। তবে আমরা নিছক কথার কথা হিসেবে কিছু বলি না। তবে এটাও ঠিক যে, কয়েকটা বাচ্চা ছেলের বেড়াতে যাওয়া নিয়ে অনেকটাই বাড়াবাড়ি হচ্ছে।” অর্থাৎ স্বাস্থ্য দফতরের সর্বোচ্চ মহল থেকেই তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার নির্দেশ যে গিয়েছে, তা মোটামুটি পরিষ্কার। শৃঙ্খলা ভাঙা নবীন ডাক্তারদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের এমন প্রশ্রয়ের মনোভাবে প্রবীণ চিকিৎসকেরা ক্ষুব্ধ।
অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে হইচই হওয়ায় ভয় পেয়ে ওষুধ সংস্থার টাকায় ব্যবস্থা হওয়া ‘ডিনার পার্টি’ বাতিল করে ফিরে এসেছিলেন নীলরতনের জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাজপুরের হোটেলে তাঁদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল দু’টি ওষুধ সংস্থা। একই অভিযোগ উঠেছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ৮০ জন জুনিয়র ডাক্তারের বিরুদ্ধেও। তাঁরাও ছুটি না-নিয়ে কাজ ফেলে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন মন্দারমণিতে। এবং তাঁরাও ওষুধ সংস্থার সৌজন্যেই দেদার পানভোজন করেছেন বলে অভিযোগ। সদ্য পাশ করা ডাক্তারদের জন্য কেন এত টাকা খরচ করছে সংস্থাগুলি?
নীলরতনের মেডিসিন বিভাগের এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, “হিসেবটা খুব সহজ। ‘ক্যাচ দেম ইয়ং।’ আউটডোর, ইমার্জেন্সি, ইন্ডোরেও এখন জুনিয়র ডাক্তারেরাই একটা বড় অংশ জুড়ে থাকেন। তাঁদের প্রভাবিত করে রাখলে প্রেসক্রিপশনে তার প্রতিফলন ঘটবেই ঘটবে।”
প্রশ্ন উঠেছে, চিকিৎসার মতো আদর্শ পেশায় নীতি ভেঙে এই দেওয়া-নেওয়ার খেল্ চলবে কেন? পাল্টা প্রশ্ন তুলে জুনিয়র ডাক্তারেরা বলছেন, সিনিয়রদেরও অনেকেই তো ওষুধ কোম্পানির টাকায় বিদেশ ভ্রমণে যান। সেটাও তো নিয়মবিরুদ্ধ। সে-ক্ষেত্রে কেউ কিছু বলে না কেন?
|