|
|
|
|
লোক আনেনি জনগণের কমিটিও |
কাঠগড়ায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, পূরণ না হওয়া উন্নয়নের আশ্বাস |
কিংশুক গুপ্ত • বিনপুর |
জনসমুদ্রের মাঝে নীল পাড় সাদা শাড়ি দেখতেই অভ্যস্ত এই রাজ্য। দল তো বটেই, দলের বাইরেও বহু মানুষ তাঁকে জননেত্রী হিসেবেই মেনে এসেছেন এত দিন। মঙ্গলবার সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভাতেই মাঠ ভরল না জঙ্গলমহলের বিনপুরে।
যে মাঠে স্বচ্ছন্দে হাজার পঁচিশেক লোক ধরে, এ দিন দুপুরে সেখানেই মেরে-কেটে হাজার পাঁচেকের ভিড়। যা দেখে এই মাঝ-বসন্তেও মমতা বললেন, “এটা গরমকাল। এত রোদে বেলা ১২টায় সভা হয় না। মাথার উপরে ছাউনি দিলে ভাল হতো। এটা আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে। আগামী দিনে হবে না। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আর কেউ বক্তৃতা দেবে না। আমি বক্তৃতা দিয়ে সভা শেষ করে দেব।”
পঞ্চায়েত ভোটের আগে মমতার সভায় ভিড় না-হওয়ায় তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়েছে। রাজ্যস্তরের নেতারাও বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামই যেখানে ইউএসপি, সেখানে বিনপুরের মতো জায়গায় কেন লোক হল না, তা ভাবার বিষয়!” দলের অন্দরের খবর, ক্ষুব্ধ স্বয়ং মমতাও।
প্রত্যাশিত ভাবেই খুশি সিপিএম। শ্যামল চক্রবর্তীর টিপ্পনি, “এত দিন তো দেখেছি, মমতার সভার তিন-চার ঘণ্টা আগে থেকে লোক বসে থাকে। তাদের বোধহয় মোহভঙ্গ হয়েছে। হয়তো ভয়ও পাচ্ছে যে, শিলাদিত্যের মতো জেলে না ঢুকতে হয়।” দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের মতে, “ঘোষণা ও রূপায়ণের মধ্যে যে বিরাট ফারাক, তাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মানুষের দূরত্ব তৈরি করেছে।” বস্তুত, এ দিন রাস্তার কাজ সময়মতো না-হওয়ার কথা কবুল করেছেন মমতা নিজেই। সভায় দেখা গিয়েছে সেতুর দাবিতে প্ল্যাকার্ডও।
৫ নম্বর রাজ্য সড়কের ধারে ধানজমি সমতল করে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক জনসভার যে আয়োজন করা হয়, তাতে বাঁশের ঘেরাটোপ বানিয়ে, চট পেতে বহু মানুষের বসার বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু সামনের কিছুটা অংশ বাদে বাকি মাঠ ফাঁকাই পড়েছিল। সকাল সওয়া ১১টা নাগাদ ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় বিনপুর রওনা দিতেই প্রমাদ গোনেন তৃণমূলের জেলা নেতারা। সভাস্থল থেকে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা মোবাইলে জানান, মাঠে তেমন লোক নেই। ১২টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে উঠে ঝটিতি লোকজনের সংখ্যা দেখে নেন। তার পরে বিরস মুখে বসে পড়েন। মঞ্চ থেকে নেমে খোঁজখবর নিতে দেখা যায় মুকুল রায়কে। মাঠে তখন সাত-আটশো লোক। দুই মেদিনীপুরের একগুচ্ছ প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধনের ফাঁকে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়। তবে তাতে মাঠের চার ভাগের এক ভাগও ভরেনি। |
|
ভিড় কই! প্রায় ফাঁকা মাঠেই চলছে মমতার সভা। মঙ্গলবার দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি। |
অতীতে এর থেকেও অনেক বেশি গরমে, চড়া রোদ উপেক্ষা করে জঙ্গলমহলের মানুষ মমতার সভা ভরিয়েছেন। গত বছর এপ্রিলে তীব্র গরমের মধ্যেও লালগড়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভায় হাজার দশেক লোক হয়েছিল। সেই তুলনায় এ দিন গরম কমই ছিল। আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, মঙ্গলবার জঙ্গলমহলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি, আর বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৬৭%।
তবু লোক হল না কেন? তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব সময় বিভ্রাটকে দায়ী করছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষের দাবি, “আমরা জানতাম বেলা ১২টায় সভা। কিন্তু প্রশাসন জানিয়েছিল, সভা দুপুর ২টোয়। তাই প্রথমে লোক হয়নি। শেষের দিকে অনেকে এসেছিলেন।” মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, “হাজারে হাজারে মানুষ আসতে শুরু করে দিয়েছেন, আমরা যখন সভা শেষ করব, তখন তাঁরা এসে পৌঁছবেন। এ জন্য আমি দুঃখিত।” বাস্তবে অবশ্য সভার শেষে কাউকেই আসতে দেখা যায়নি। আর প্রশাসন জানিয়েছে, গোড়া থেকেই ১২টায় সভা হবে বলে ঠিক ছিল।
বিরোধীরা আবার দাবি করছেন, মমতা বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে তৃণমূলের সভা ভরাতো জনগণের কমিটি। এখন সেই গাঁটছড়া ছিঁড়ে যাওয়াতেই বিপত্তি। কংগ্রেসের ঝাড়গ্রাম মহকুমা সভাপতি প্রসূন ষড়ঙ্গীর ব্যাখ্যা, “নিচুতলায় তৃণমূলের সংগঠন সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। এখন জনগণের কমিটির মতো কেউ পাশে নেই যে সভায় লোক ভরাবে।”
এটা যদি ভিড় কমার একটা কারণ হয়, অন্য কারণ অবশ্যই শুভেন্দু-মুকুল গোষ্ঠীর কাজিয়া। তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দলীয় ভাবে জঙ্গলমহলের দায়িত্ব পান সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। তখন তাঁর জেলা পূর্ব মেদিনীপুর থেকে বাস বোঝাই করে বহু লোক আসতেন। ইতিমধ্যে জঙ্গলমহলে প্রভাব বাড়াতে তৎপর হন মুকুল। তাঁর অনুগামী গোষ্ঠীও গড়ে ওঠে। এ দিনের সভায় শুভেন্দু-মুকুল দু’জনেই ছিলেন। তবে দলের একাংশের দাবি, শুভেন্দু নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখাতেই এই দশা।
শাসক দলের একাধিক রাজ্য নেতা বলছেন, বিনপুরে লোকবসতি কম। ফলে সভায় লোক আনতে হতো দুই মেদিনীপুরের অন্যান্য এলাকা বা বাঁকুড়া থেকে। যিনি লোক আনতে পারতেন, সেই শুভেন্দুর সহযোগিতা সে ভাবে চাওয়া হয়নি। মুকুল সভা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়, প্রদ্যোৎ ঘোষদের। এ প্রসঙ্গে শুভেন্দু অবশ্য বলেন, “এটা তো প্রশাসনিক সভা। সব তারাই করেছে।” তৃণমূলের এক নেতাও বলেন, “লোক আনার জন্য জেলা প্রশাসনের যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, তা নেওয়া হয়নি।” নেত্রীর ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রয়েছে বোঝাতে পঞ্চায়েত ভোটের আগে জঙ্গলমহলে দলীয় সভা করার কথাও ভাবা হচ্ছে। |
|
সভায় লোক না-হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে উঠে এসেছে অনুন্নয়ন নিয়ে ক্ষোভও। গত এপ্রিলে লালগড়ের সভামঞ্চে নেতাই গ্রামের তরুণী জনতা আদক মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, লালগড়-নেতাই রাস্তার কাজ শুরুই হয়নি। দ্রুত রাস্তা তৈরির নির্দেশ দেন মমতা। এ দিন সেই রাস্তার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “ঠিকাদাররা বদমায়েশি করেছিল। এখন কাজ এগোচ্ছে।” যদিও সেই কাজ এগোচ্ছে শম্বুকগতিতে। অন্য উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও মানুষের অসন্তোষ রয়েছে। এ দিনের সভায় বেলপাহাড়ির তারাফেনি এবং লালগড়ের পাপটপুরে সেতুর দাবিতে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড চোখে পড়ে। জেলা তৃণমূলের এক নেতা মেনে নেন, “মানুষের কাছে উন্নয়ন প্রকল্প যথাযথ ভাবে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া দলের একটি গোষ্ঠী যে ভাবে সিপিএমের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, তাতে মোহভঙ্গ হচ্ছে।” প্রশ্ন উঠছে তৃণমূলের কিছু স্থানীয় নেতার আচরণ নিয়েও। বিনপুরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা ঝাড়খণ্ড পার্টির (নরেন) নেত্রী চুনিবালা হাঁসদার অভিযোগ, “৩ মার্চ এক যুব তৃণমূল নেতা ও তাঁর দলবল আমাদের সমর্থক দুই আদিবাসী বধূর শ্লীলতাহানি করেন। পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। এ সব কারণেই মানুষ তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।” |
|
|
|
|
|