প্রবন্ধ ২...
কেবল পাশে থাকব? প্রশ্ন তুলব না?

২৪ আষাঢ়, ১৩৭৪
সরকারের এক বিশেষ নির্দেশে রেডিয়ো পাকিস্তান, ঢাকা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। আজ এরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাদ দিচ্ছে, কাল এরাই বলবে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুসলিম ঐতিহ্যের অনুকূলে নয়। এদের এই বহুল ব্যবহৃত মুসলিম ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে এরা আরও কত কী যে করবে, তা ‘খোদাই মালুম’ না বলে, বলতে হয়, ‘মুজিবই মালুম’...

ডায়েরির মালকিন লুৎফান্নাহার হেলেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে যখন লিখতে পেরেছেন এই লাইনগুলো, তখন কয়েক বছরের মধ্যে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? এবং ধরাও পড়লেন, রাজাকারদের মদতে। হেলেন ইতিমধ্যে ২ বছর ৫ মাসের ফুটফুটে ছেলের (দিলীর) মা। ধরা পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আনা হল পাক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মীদের কাছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। ক’দিন বাদে তাঁর ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হল মামাবাড়িতে। তার পর? অত্যাচারে, উপর্যুপরি ধর্ষণে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটি জিপের পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হল শহরের রাস্তা দিয়ে, ফেলে আসা হল নবগঙ্গার ডাইভারশন ক্যানালে। তখনও ২৪ পেরোননি হেলেন।
হেলেন উদাহরণমাত্র। রাজাকার, আল-বদ্র, আল-শামস্-দের অত্যাচারে প্রাণ হারানো আরও অনেক অনেক হেলেনের আত্মীয়রা কোনও দিন কি ক্ষমা করতে পারবেন এই রাজাকারদের? তাই শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বর’ থেকে যখন স্লোগান ওঠে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে, মৌলবাদী সংগঠনগুলি নিষিদ্ধ করার দাবিতে, অনুমান করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের আত্মীয়রা আশ্বস্ত হন ইনসাফ হবে।
শাহবাগকে অভিবাদন। শাহবাগ আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো এ পার বাংলার মানুষ, আর প্রকাশ্যে সরব হওয়া ‘বুদ্ধিজীবী’দেরও। নিজেদের কোনও রাজনৈতিক শিবিরে ভাগ না করে, একই প্রশ্নে একই সঙ্গে সবাই একই সুরে গলা মেলাচ্ছেন শেষ কবে এমনটা হয়েছে, মনে পড়ে না।
কিন্তু প্রাথমিক বাহবা-প্রদান-পর্ব মিটলে পর, একটু তলিয়ে ভাবলে, তিনটে ব্যাপারে খটকা লাগতে বাধ্য। প্রথম খটকা, আজমল কসাব কিংবা আফজল গুরুর ফাঁসির ক্ষেত্রে যাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মৃত্যুদণ্ড কোনও অপরাধকে নির্মূল করতে পারে না, তাঁরা অনেকে শাহবাগের ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’ স্লোগানকে প্রশ্নহীন সমর্থন জোগাচ্ছেন? যদি মেনে নিতে হয় যে, দুই ক্ষেত্রেই তাঁদের অবস্থান যুক্তিযুক্ত, অর্থাৎ কাদের মোল্লা সহ অন্যান্য রাজাকারদের সঙ্গে আফজল গুরু বা কসাবের অপরাধের গুণগত ফারাক আছে, তাই মৃত্যুদণ্ড ‘প্রেক্ষিত’নির্ভর, তা হলে তো সর্বনাশ! কারণ এই যুক্তির লাইনে খানিক আপ-ডাউন করলে অমোঘ স্টেশন: মাওবাদীদের জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে হামলা আর লস্করের ২৬/১১ হামলার প্রেক্ষিত যেহেতু ভিন্ন, তাই একটা ঘটনা আর একটার চেয়ে কম নিন্দনীয়! ঘটনা হল, মৃত্যুদণ্ড যে প্রেক্ষিতে, যে অপরাধেই দেওয়া হোক না কেন সমর্থনযোগ্য নয়। আর তাই যত লক্ষ মানুষই স্লোগান তুলুক না কেন, রাজাকারদের ফাঁসির দাবি সমর্থন করা যায় না।
ফাঁসি চাই? কেন? প্রশ্নটা কিন্তু আছে, থাকা দরকার। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ছবি: এ পি।
শাহবাগের দ্বিতীয় দাবি: মৌলবাদী সন্ত্রাস ছড়ানো সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই এ দাবিও সমর্থন করছেন। এবং দ্বিতীয় খটকা। এই তো সে দিন সলমন রুশদিকে ঢুকত না দেওয়া নিয়ে মিডিয়ায় খানিক হইচই, অনেকেরই হালকা গাঁইগুঁই, বাক্-স্বাধীনতার পক্ষে প্রাথমিক সওয়াল, কিন্তু সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে কোনও পক্ষই তেমন ভাবে মাঠে নামলেন না, কেউ-বা বললেন, “লেখকেরও তো একটা দায়িত্ব থাকে, না কী? যদি কেউ প্রোভোক্ড হয়?” তা, এহেন বুদ্ধিজীবীরা হঠাৎ শাহবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার পাশে কেন? সীমান্ত পেরিয়ে অ্যাসিড বোমা এসে গায়ে লাগবে না, তাই জামাত-এর বিরুদ্ধে মুখ খোলা নিরাপদ? বহু কট্টরপন্থী, হিন্দুত্ববাদী দল, যারা প্রতিনিয়ত নানা প্রশ্নে ধর্মীয় জিগির তুলে লোক খেপাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে এঁরা কিন্তু পথে নামছেন না। অর্থাৎ মোদ্দা কথা: ‘সেফ ডিসট্যান্স’-এর সুবাদে বিদেশ-নীতি যতই খাপখোলা হোক, স্বরাষ্ট্র-খাতে সেই মশারি।
তৃতীয় খটকা, যাঁরা বছর কয়েক আগেও মাওবাদী ও অন্যান্য অতি-বাম সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন, তাঁরাই সহমত পোষণ করছেন জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে। কেন? মাওবাদীদের ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল: “সন্ত্রাসের পথ বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথে যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের এই পথ থেকে সরাতে গেলে, আগে বোঝা দরকার এই পথে হাঁটার কারণটা কী।” তা হলে, জামাতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন হবে? বস্তুত, যে কোনও মৌলবাদী সংগঠন মনে করে তারা যা ভাবছে তা ঠিক, সেই ‘ঠিক’টা তারা তাদের নিজস্ব পন্থায় পৌঁছে দিতে চায় আমজনতার কাছে। তা হলে রাষ্ট্র কী করবে? বাক্-স্বাধীনতার মানে কিন্তু ভুল বক্তব্য বলারও সমান স্বাধীনতা। যুক্তিহীনকেও তার কথা বলার সুযোগ দেওয়া। যদি কেউ বাক্-স্বাধীনতার অপব্যবহার করে প্ররোচনা বা উস্কানি দেয়, ত্রিগুণ প্রাবল্যে রাষ্ট্রকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাল্টা যুক্তি সাজিয়ে পৌঁছতে হবে মানুষের কাছে। সংঘাত হোক যুক্তির। পেশির নয়। বুদ্ধিজীবীরা এ সবই জানেন, বোঝেন, কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায়। মিডিয়া সভা ডাকলে সেখানে দলে পড়ে সক্কলে মিলে বলে ওঠেন, ‘পাশে আছি, শাহবাগ’। দাবির গভীরতা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে নিজেদেরই হাস্যকর করে তোলেন।
দ্বিগুণ হাস্যকর কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান। তাদেরই শাসনকালে রাজ্য-ছাড়া হতে হয় তসলিমা নাসরিনকে। তিনি ভয় পাননি, রাজ্য সরকারই ভয় পেয়েছিল মৌলবাদীদের। আর আজ তাঁরাই বিবৃতি দিয়ে মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পাশে থাকার ডাক দিচ্ছেন। তাঁরাও জানেন দূরত্ব বুঝে নিয়ে প্রতিবাদ করতে হয়। আমেরিকা তাই বরাবর সবচেয়ে সহজ টার্গেট।
এ লেখা একটি বারের জন্যও শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে কথা বলছে না। মৌলবাদের মতো সমস্যাকে উপড়ে ফেলতে এক দল তরুণ তাঁদের উদ্দাম প্রাণশক্তি, সৎ আবেগ, দেশাত্মবোধকে সম্বল করে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের মাথার ওপর তেমন কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। এঁরা আওয়ামি লিগের একচেটিয়া হয়ে যাওয়া ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ফিরিয়ে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্যাশন, এঁদের পাশে না দাঁড়ানো মূর্খামি। কিন্তু শাহবাগের সবচেয়ে বড় মূলধন আবেগ। আর আবেগ বলেই, পদে পদে যুক্তির পথ থেকে বিচ্যুতির ভয়। যাঁরা এই মুহূর্তে শাহবাগে, এ-রকম অনেক ভুল তাঁদের চোখে পড়বে না। সেটাই স্বাভাবিক। এবং ঠিক সেখানেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ডের প্রয়োজন। ‘পাশে আছি’ বলে কাব্য করলে, গান বাঁধলে যতখানি পাশে থাকা হয়, আন্দোলনকারীদের কাছে যুক্তির মাধ্যমে আত্মবিশ্লেষণের বার্তা পৌঁছে দিলে তা অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভাবে পাশে থাকার নমুনা হয়ে ওঠে। এ পার বাংলায় থেকে ও পারের আন্দোলনে আন্তরিক ভাবে শামিল হতে গেলে প্রয়োজনে শাহবাগ থেকে ওঠা দাবিকে প্রশ্ন করতে হবে। না হলে পৃথিবীর ইতিহাসে যা অতি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হয়ে উঠতে পারে, তা পর্যবসিত হবে আর পাঁচটা দারুণ শুরু করেও ভুস করে নিভে যাওয়া তুবড়ি গোত্রের আন্দোলনে।
তবে তার আগে নিজেদের প্রশ্ন করার সময় হয়েছে। আর কত দিন আমরা মৌলবাদী সংগঠন বলতে লস্কর-ই-তইবা বা যাবতীয় মুসলিম মৌলবাদীদের কথা মনে করব? হিন্দুত্বের শিবিরেও মৌলবাদীরা আছে, তারাও সমান নিন্দনীয়। আর আমার দেশে এই দ্বিতীয় সংখ্যাটাই বেশি। তাই মৌলবাদ-বিরোধিতার নামে স্রেফ বর্ডার পারের মৌলবাদকে ইঙ্গিত করা বন্ধ হোক। তসলিমা নাসরিনকে ফিরিয়ে আনতে পথে নামা হোক। খোলা মঞ্চে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হোক সলমন রুশদিকে। প্রয়োজনে আমরা দেব নিরাপত্তা।
আর বুদ্ধিজীবীরা অনুগ্রহ করে মশারি ছেড়ে বেরোন। দেখবেন চেনা ছকের বাইরে, অ্যাঙ্করের নাটকীয় সংলাপ, ক্যামেরা, বুম-এর বাইরে একটা বিশাল জগৎ অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। যা বদলাতে পারেন আপনারাই। এখনও সময় আছে, সেই সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গায়ে লেগে থাকা ‘হিপোক্রিট’ তকমাটা ঝেড়ে ফেলার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.