কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসী মানুষের আন্দোলনে তাঁদের নিজেদের নেতৃত্ব
এ দেশে
আজও সুলভ নয়। যদি বা তেমন নিজস্ব আন্দোলন হয়,
তার কথা আমরা জানতেও পারি না। জয়া মিত্র |
আমাদের এ দিকে অন্তত কোথাও কোনও খবর চোখে পড়েনি। ৪ ফেব্রুয়ারি একশো বছর পূর্ণ করলেন রোজা পার্কস (১৯১৩-২০০৫)। না কি রোজা পার্কসরা পড়েন না, উঠে দাঁড়ান আর চলতেই থাকেন? রোজা পার্কস চলা শুরু করেছিলেন ১৯৫৫’র ১ ডিসেম্বর? এক বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গে হেঁটেছিলেন পঞ্চাশ হাজারের বেশি কালো মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঞ্চলে তখনও তীব্র বর্ণবিদ্বেষ। পাবলিক বাসে একই ভাড়া দিয়েও সিটে বসার অধিকারী নন আফ্রিকান-আমেরিকানরা। দিনভর দরজির কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন উত্তর-চল্লিশ রোজা। এক জন যাত্রী বাসে ওঠায় কন্ডাক্টর তাঁকে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে বলেন। রোজা রাজি হননি। পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। খবর জানাজানি হতে বাসে শুরু হয় বিখ্যাত ‘মন্টগোমারি বাস বয়কট’, যা সম্মানিত হয়েছে ‘প্রথম নাগরিক অধিকার আন্দোলন’ বলে। কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নয়, আহত মানুষদের নিজস্ব মর্যাদার অধিকার দাবি করে আন্দোলন, অন্যায় বিধানের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৮৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর বিখ্যাত ‘মুক্তির ঘোষণা’তে বলেন, মার্কিন দেশে গায়ের রং নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের কথা, যা ছিল মানুষ কেনাবেচার কলঙ্ক থেকে সাদা সভ্যতার মুক্তি পাওয়ার স্বীকৃত সনদ। তার একশো বছর পরেও, ১৯৬৩ সালে, আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার আগে, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে উচ্চারণ করতে হবে বহু মানুষের ‘রামধনু ধরবার ক্লান্ত আয়োজন’-এর কথা, ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ নামে যে ভাষণ যত্নে আধারিত থাকবে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে। প্রসঙ্গত, নবনিযুক্ত যে তরুণ যাজক ‘মন্টগোমারি বাস বয়কট’ আন্দোলনের সঙ্গে দীপ্ত ভাবে জড়িয়ে গেলেন, তাঁরই নাম মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। |
জন-আন্দোলন। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। কুডনকুলম, মার্চ ২০১৩। ছবি: পি টি আই |
কনকনে ডিসেম্বরে মন্টগোমারির হাজার হাজার অশ্বেতাঙ্গ মানুষ সরকারি যানবাহন বয়কট শুরু করেন। কাজে যাতায়াত শুরু হয় ‘কার পুল’ করে, কালো চালকদের টাক্সিতে, চার্চের গাড়িতে আর হেঁটে। প্রতিদিন রাস্তায় সরকারি-বেসরকারি বাস প্রত্যাখ্যান করে হাঁটতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ। শ্রমিক, পেশাজীবী, ছাত্রছাত্রী, প্রবীণ, সবাই। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিগুলির ব্যবসা কার্যত লাটে ওঠে। কালো মানুষরাই তো ছিলেন আরোহীদের সিংহভাগ। বাসের পর বাস খালি দাঁড়িয়ে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দলে দলে মানুষ, গমগম করছে তাদের সম্মেলন-গান ‘উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে’। এই শান্ত প্রত্যাখ্যান কী নৈতিক মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে অন্যায়কারীর ওপর, তার কিছুটা ভারত জানে। তার কাছে ক্ষমতাকে মাথা নোয়াতেই হয়।
রোজা কি কোনও আকস্মিকতা? বিরানব্বই বছর বয়সে রোজার মৃত্যুর পর মিডিয়া তাঁকে চিত্রিত করেছিল ‘ক্লান্ত, অতি প্রবীণ এক মহিলা দরজি’ বলে। তাঁর জীবনীকার জিন থিয়োহ্যারিস (দ্য রেবেলিয়াস লাইফ অব মিসেস রোজা পার্কস) প্রত্যাখ্যান করছেন সেই পরিচয়, ভারী আদর করে বলছেন, মোটেই নির্বিরোধী বৃদ্ধা দরজি নন, ‘রোজা ওয়াজ আ ফার্স্ট-ক্লাস ট্রাবলমেকার’। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে একটি রেডিয়ো ইন্টারভিউয়ে রোজা পার্কস বলেছিলেন, ‘দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল আমাদের। আর পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।’ দক্ষিণের পাইন লেভেল, যেখানে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছিলেন রোজা, সেখানে অশ্বেতকায় ছাত্রছাত্রীদের বাসে ওঠার নিয়ম ছিল না। ‘বাসই প্রথম’, বলছেন রোজা, ‘যেখান থেকে আমি জেনেছিলাম যে দুটো পৃথিবী আছে: সাদা পৃথিবী আর কালো পৃথিবী।’ ঠিক যেমন আমরা জানি মেয়েদের পৃথিবী আর পুরুষের পৃথিবী। কিংবা, ক্ষমতাবানের পৃথিবী আর অধিকারহীনের পৃথিবী।
অধিকারহীনের কালো পৃথিবীতে একটু একটু করে বড় হতে থাকা বালিকা রোজা রোজ দাদু-ঠাকুমার কাছে শিখত ‘মাথা সোজা করে দাঁড়াও। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো। ‘স্যর’ বলো, কিন্তু মাথা সোজা রেখে বলো।’ যে স্কুলে যেতে শুরু করেন রোজা, সেই হাইল্যান্ডার ফোক স্কুল ছিল সাদা ও কালো কমবয়সিদের নানা রকম ভাবনা ও উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকা একটা জায়গা। এখানেই পিট সিগার ও তাঁর বন্ধুরা। এখানেই ভেঙে যাচ্ছে সাদা-কালোর সরলীকৃত আড়াআড়ি বিভেদরেখা। স্পষ্ট হয়ে উঠছে অধিকার দখল করে রাখাদের সঙ্গে অধিকার ভাগ করে নিতে চাওয়াদের অমিল। সাদাদের সঙ্গে, এবং হ্যাঁ, কালোদেরও মধ্যে। সমান মর্যাদার অধিকারে বিশ্বাসী মানুষদের নতুন প্রতিরোধ তৈরি হতে লাগল। ক্ষমতার আগ্রাসী ভঙ্গিকে শান্ত ভাবে প্রত্যাখ্যানের প্রতিরোধ। তাই, বাইরে থেকে যাকে দেখলে মনে হয় কৃচ্ছ্রসাধন, কঠোর পরিশ্রমের কষ্টসাধ্যতা, ১৯৫৫-র শীতে হাজার হাজার মানুষের যোগদানে, উষ্ণতায়, ভালবাসায় তা হয়ে উঠল যেন এক উৎসব। পিট সিগারের মতো, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের মতো, রোজা পার্কসের মতো সবল বৃক্ষেরা সেই অধিকার আন্দোলনের নতুন জমিতে পা গেঁথে দাঁড়ালেন। দেশের সরকার যখন নিজের গড়া আইন মানে না, তাকে বাধ্য করলেন সেই ব্যবস্থা মানতে।
১৯৫৬ সালের মে মাসে ফেডারাল কোর্ট রায় দেয় মন্টগোমারিতে বাসে বর্ণভিত্তিক বিভাজনের (Segregation) প্রথা অসাংবিধানিক। আজকের নতুন শতাব্দীতে মানবিক মর্যাদার দাবি ও তা রক্ষা করার অধিকারই হয়তো প্রধানতম সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ভূমি হয়ে উঠবে। নানা চেহারায় অদূর অতীতের মর্যাদার অধিকার আন্দোলন রোজা পার্কসের শতবর্ষকে এক নতুন উদ্ভাস দেয়।
রোজা ও তাঁর সঙ্গীদের অসাধারণ আন্দোলন কিছু উদ্ধত দাম্ভিক ক্ষমতাশালীকে শস্ত্রহীন, অনুচ্চকণ্ঠ সাধারণ মানুষদের সামনে নতজানু হতে বাধ্য করেছিল। মনে না করে পারা যায় না যে, এ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ ছিল সেই অশ্বেতকায় মানুষদেরই হাতে, যাঁরা অবমানিত হচ্ছিলেন। আন্দোলনের প্রাণধ্বনি রচয়িতা পিট সিগারের মতো আরও কিছু সাদা মানুষও জড়ো হয়েছিলেন এই নিঃশব্দ সংগ্রামের আশপাশে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আন্দোলনের রশি ছিল কালো মানুষদের হাতেই।
পক্ষান্তরে, আমাদের ‘গণতান্ত্রিক’ দেশে দেখি, যাদের জন্য আন্দোলন, তারা, আর যে কোনও আন্দোলনের পরিচালক নেতৃত্ব ভিন্ন। কৃষকের কী জন্য আন্দোলন করা প্রয়োজন, সে সিদ্ধান্ত কৃষক নেন না, অন্যরা কৃষককে সচেতন করেন এবং শেষ পর্যন্ত নেতৃত্বও দেন তাঁরাই। ‘সচেতন’ কৃষক, আদিবাসী, শ্রমিকদের কিছু জন সেই নেতৃত্বকে কিছু দূর অনুসরণ করেন মাত্র। আন্দোলন ‘সংগঠিত হয়’, ওঠে এবং পড়ে। সে আন্দোলনের ইতিহাসও বিবৃত হয় সেই ভাবেই। মিডিয়াও সেই আন্দোলনকে কিছুটা গুরুত্ব দেয়, যা এই চেনা প্যাটার্নকে রক্ষা করে চলে।
আর যেখানে তার অন্যথা হয়? যেখানে কৃষকরা রাসায়নিক ও জেনেটিক কৃষিকে নিঃশব্দে প্রত্যাখ্যান করে দেশের অনেকখানি জমিতে ধীরে ধীরে নিজেদের পরম্পরাগত চাষ আবার ফিরিয়ে আনেন? যেখানে হাজার হাজার আদিবাসী মুখ-নাক-বুক চেপে ধরা বেআইনি পাথরখাদান ও ক্রাশারগুলোকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেন? অভ্যস্ত প্রাচীন সুস্থ জীবনযাপনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন? সেই সব দীর্ঘস্থায়ী, গঠনমূলক, প্রকৃত পরিবর্তন ঘটানো আন্দোলন পাঁচ-সাত-দশ বছর ধরে চলতে থাকলেও মিডিয়ায় গুরুত্ব পায় না, ক্রিকেটে ক্রীত-স্টার বিক্রির উল্লাসধ্বনি, ফিল্মি গন্ধর্বদের বিয়ের পোশাক কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতি ও বিবৃতির নীচে চাপা পড়ে থাকে।
হয়তো এটাই হওয়ার। যে ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে, যে কাঠামোয় আমাদের আধুনিক সভ্যতার নির্মাণ ও বিকাশ, তার সাংস্কৃতিক ধাঁচকেই এখনও আমরা সগৌরবে বহন করি। সাত হাজার বছরের প্রাচীন এই কৃষি-সভ্যতার দেশে আজও কৃষিই সর্ববৃহৎ উৎপাদন মাধ্যম, সর্বাধিক সংখ্যার মানুষ কৃষি সম্পর্কিত কাজে নিযুক্ত ও গ্রামে বাস করেন, অথচ এ দেশের অধিবাসীদের পরিচিতিবাচক শব্দ আজও ‘নাগরিক’। গ্রেকো-রোমান আদলে পশ্চিমি সভ্যতার ‘সিটিজেন’ শব্দের কোনও বাস্তবসম্মত, স্বাভাবিক প্রতিশব্দ যদি এত বছরেও ভাবা না হয়ে থাকে, তা হলে আর কার আন্দোলন, কারই বা ‘লিডারশিপ’! |