শিক্ষার অধিকার আসিয়া শিখিবার অধিকার হরণ করিয়াছে। অর্থনীতির খ্যাতনামা অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এই ভাষায় কথাটি বলেন নাই। কিন্তু সোমবার বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত এক আলোচনাসভায় তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহার মূল সুরটি এমনই। ‘সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার’ সংক্রান্ত আইন লইয়া দেশে ইতিমধ্যে বিস্তর আলোচনা শোনা গিয়াছে। কিন্তু সেই কথাসরিৎসাগরের মূল প্রতিপাদ্য একটিই: এই আইন যথেষ্ট জোর দিয়া এবং যথেষ্ট উদ্যোগের সহিত রূপায়ণ করা হইতেছে না, এখনও অনেক স্কুল, অনেক শিক্ষক, অনেক ব্ল্যাকবোর্ড, অনেক আরও-অনেক-কিছু চাই। এক কথায়, সর্বজনীন শিক্ষা সম্ভব করিয়া তুলিবার জন্য আরও অনেক উপকরণ চাই। স্বভাবতই, শিক্ষায় সরকারি ব্যয়বরাদ্দ যথেষ্ট বাড়াইবার দাবিও প্রবল ভাবে তোলা হইয়াছে। ইহার কোনওটিই অপ্রয়োজনীয় নয়। শিক্ষা আকাশ হইতে পড়িবে না, মাটি ফুঁড়িয়াও উঠিবে না, তাহার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিতে হইবে, সেই ব্যবস্থার নানা দাবি রহিয়াছে, তাহা পূরণ করিতে হইবে। যথেষ্ট শিক্ষক, যথেষ্ট ব্ল্যাকবোর্ড ও চকখড়ি, যথেষ্ট স্কুলঘর, মিড-ডে মিলের জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম, সকলই আবশ্যক। কিন্তু ‘আবশ্যক’ এবং ‘যথেষ্ট’ এক নহে। এই দুইয়ের পার্থক্যটি সম্যক না বুঝিলে বিস্তর বিপত্তির সৃষ্টি হয়। তখন মনে হইতে পারে, শিক্ষা বিস্তারের উপকরণ বাড়াইলেই বোধ করি শিক্ষার যথেষ্ট বিস্তার হইবে।
তথ্য-পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, গত কয়েক বছরে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মান উন্নত হয় নাই, নামিয়া গিয়াছে। যে শ্রেণির ছাত্রছাত্রীর যাহা শিখিবার কথা, তাহারা অনেকেই তাহা শেখে নাই, এক বিরাট অংশ কার্যত কিছুই শেখে নাই। সমস্যাটি নূতন নহে, কিন্তু গত কয়েক বছরে ‘সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার’-এর ঢক্কানিনাদের মধ্যে সমস্যা তীব্রতর হইয়াছে, না-শিখিবার অনুপাত কমিবার বদলে বাড়িয়াছে। কেন? অভিজিৎবাবুর মতে, শিক্ষার অধিকারের উপর জোর দিতে গিয়া ছাত্রছাত্রীরা কী শিখিতেছে, কতটা শিখিতেছে, সেই প্রথম এবং প্রধান প্রশ্নটিকে অবহেলা করা হইয়াছে, হইতেছে। শিক্ষার মূল্যায়নের যথার্থ কোনও বন্দোবস্তই হয় নাই। ফলে, ঈষৎ বৃহত্তর ও ভিন্নতর অর্থে, তোতাকাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটিতেছে: আয়োজন ভূরিপরিমাণ, শিক্ষা তিলপরিমাণ। সমালোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ। পড়ুয়ারা লেখাপড়া কেমন শিখিতেছে, তাহার মূল্যায়ন লইয়া চিরকালই বিস্তর সমস্যা ছিল, কিন্তু আগে অন্তত মূল্যায়নের একটা চেষ্টা জারি থাকিত। প্রচলিত পরীক্ষা তুলিয়া দিয়া ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’-এর যে পদ্ধতি সাধারণ ভাবে বলবৎ হইয়াছে, তাহার তাত্ত্বিক বা আদর্শগত মূল্য যাহাই থাকুক, কার্যক্ষেত্রে এই নববিধানটি সার্বিক ফাঁকির সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করিতেছে। ইহা একমাত্র সমস্যা নয়, কিন্তু একটি বড় সমস্যা। আরও বড় কথা, এই সমস্যার মূলে কাজ করিতেছে একটি মানসিকতা। ফলাফল বিচার না করিয়া নীতি প্রবর্তনের মানসিকতা। ইহার সংশোধন জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে। |