পাকিস্তানের পার্লামেন্ট এই প্রথম তাহার মেয়াদ পূর্ণ করিল। মেয়াদপূর্তির এই ‘রেকর্ড’ গড়িতে একটি রাষ্ট্রের ৬৬ বছর লাগিল, ইহা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই গোটা ইতিহাসের অর্ধেক সময়টাই দেশটি সেনা-ছাউনি হইতে শাসিত হইয়াছে কিংবা সেনা-ছাউনি হইতেই জেনারেলরা দেশের রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে উঠিয়া আসিয়াছেন। বাকি যে অর্ধেক যুগ, সেই তিন দশকের অধিক কালে পাকিস্তানে বারংবার রাজনৈতিক দল নির্বাচনে গরিষ্ঠতা পাইয়া সরকার গড়িয়াছে। কিন্তু জেনারেলদের অপছন্দ হওয়ায় কিছু কালের মধ্যেই সেই নির্বাচিত সরকারকে নানা অজুহাতে গদিচ্যুত করিয়া সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। সেনাবাহিনীর সুবিধা হইল, জনসাধারণের কাছে তাহার কোনও জবাবদিহির দায় নাই। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেলদের মধ্যে জনতার আশীর্বাদ তথা গণতান্ত্রিক বৈধতা লাভের একটা ব্যাকুলতা থাকিয়াই যায়। সেই তাগিদ হইতেই অনেক জেনারেল উর্দি পরিয়া কিংবা প্রতীকী স্তরে উর্দি ছাড়িয়া নিজস্ব সংগঠন বানাইয়া অসামরিক রাজনীতিতে যোগ দিয়াছেন। সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত জেনারেল পারভেজ মুশারফ।
পাকিস্তানে অসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনের পূর্ণ সাংবিধানিক মেয়াদপূর্তির ঘটনায় শাসক দল পিপল্স পার্টি যৎপরোনাস্তি উৎফুল্ল। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরফ তো ইহাকে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের চূড়ান্ত জয়ের প্রমাণ রূপে পেশ করিয়াছেন। এ ব্যাপারে তিনি অবশ্য এতটা প্রগল্ভ না হইলেও পারিতেন। পিপল্স পার্টির সরকারের কৃতিত্বকে খাটো না করিয়াও বলা চলে, এই ঘটনা এখনও পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দৃঢ়মূল হওয়ার পর্যাপ্ত প্রমাণ নয়। কারণ সেনাবাহিনীর ডানা ছাঁটার কাজটিতে পাকিস্তান এখনও হাতই দেয় নাই। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রক্রিয়াগুলি যত ক্ষণ না যথেষ্ট জোরদার হইতেছে, তত ক্ষণ এ ধরনের রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কিছুতেই নিরুপদ্রব হইতে পারে না। হয়তো এই মুহূর্তে জেনারেলরা পাদপ্রদীপের আলোয় নাই, ইচ্ছাকৃত ভাবেই নিজেদের সেই আলোকবৃত্তের বাহিরে রাখিয়াছেন। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তেই তাঁহারা সামনে চলিয়া আসিতে পারেন, বিশেষত যদি তাঁহাদের কায়েমি স্বার্থ কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তা ছাড়া আগামী ষাট দিনের মধ্যে একটি তদারকি সরকারকে দেশে নির্বাচন সম্পূর্ণ করিতে হইবে। সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হইবেন, তাহা লইয়াই সরকার ও বিরোধী পক্ষে কোনও ঐকমত্য হয় নাই। মতৈক্য না হইলে নির্বাচন কমিশনের উপরেই তদারকি প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নের দায় চাপিবে। নূতন সরকার ক্ষমতায় না-আসা অবধি এই অন্তর্বর্তী কালটি বড় সংশয়াচ্ছন্ন জেনারেলদের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি বিস্তারের পক্ষে আদর্শ।
পারভেজ আশরফ পাকিস্তানে আর কখনও নির্বাচিত সরকার অভ্যুত্থানে গদিচ্যুত হইবে না বলিয়া যে আশাবাদ ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহার কোনও বাস্তব ভিত্তি নাই। সেনাবাহিনীর সক্রিয় মদতে কিংবা নিষ্ক্রিয় উৎসাহদানে পাকিস্তানে জেহাদি ইসলামের যে রমরমা, তাহা মূলত গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়ারই শক্তি। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দীর্ঘ কাল যাবৎ প্রতিবেশী আফগানিস্তানে সোভিয়েত-বিরোধী ‘মুক্তিযুদ্ধে’ বিজয় হাসিলের অজুহাতে এই শক্তিগুলিকে ব্যবহার করিয়াছে। কালক্রমে সেই শক্তি তালিবান কেবল কাবুল দখলই করে নাই, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের প্রভাবাধীন করিয়াছে। পাক তালিবানের সহিত মিলিয়াছে হক্কানি গোষ্ঠীর মতো জঙ্গিরা, লস্কর-এ-তইবার মতো বিভিন্ন গোষ্ঠীর অজস্র জেহাদি সন্ত্রাসীরা। পাক জেনারেলরা দেশের এই গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিগুলিকে নির্মূল করার বদলে পরিপোষণ করিয়াছেন। পাকিস্তানের যে কোনও স্থানে, এমনকী পাক বায়ু-সেনা বা নৌসেনার সদর দফতরেও তাহারা যথেচ্ছ বিস্ফোরণ ঘটাইতে পারে, মানববোমা পাঠায়। এ ভাবে কোনও গণতান্ত্রিক সমাজ বা ঐতিহ্যের বিকাশ হয় না। গণতন্ত্র কেবল পার্লামেন্টের মেয়াদপূর্তির ব্যাপার নয়। মেয়াদপূর্তি সুসংবাদ, কিন্তু পাকিস্তানি গণতন্ত্রকে সম্ভবত আরও অনেক পথ রক্তাক্ত পায়ে হাঁটিতে হইবে। |